রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ পূর্বাহ্ন
।।মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন, কালের খবর।।
গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার শাসন আমলে স্বজনতোষী অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির কারণে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো অর্থনীতির ‘অর্থ’ এবং ‘নীতি’ দুটোরই মূল্য কমেছে; বেড়েছে সংকট আর দুর্নীতি।সবসময় অর্থ ও নীতিকে একসঙ্গে মেলানো খুব সহজ নয়। একটি পাওয়া গেল তো অন্যটায় ঘাটতি দেখা যায়। অর্থ আছে তো নীতি নেই।আবার নীতি ঠিকঠাক, কিন্তু অর্থ নেই। তবে একই সঙ্গে দুটোরই সংকট এমনটা অনেক দিন কোথাও দেখা যায়নি। বাংলাদেশে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার শাসন আমলে অর্থ ও নীতি—দুটোরই সংকট ছিল।দেড় দশকের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে ডলার সংকট, ভঙ্গুর অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতিসহ নানাবিধ টানাপোড়েনে ছিল দেশের অর্থনীতি, এবং দেদার চলছিল লুটপাট, দুর্নীতি, অনিয়ম আর অর্থ পাচার।যার ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভীত নড়বড়ে হয়ে গেছে। আর এর কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর প্রতিবেদনে, দের দশকে দেশ থেকে প্রচার হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা। জি এফ আই এর সর্ব শেষ তথ্য মতে গত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার (১ ডলার =১১৮ টাকা) বা ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। আমদানি রপ্তানি সহ নানা কায়দায় পাচার হয়েছে এসব অর্থ।যা দেশ স্বাধীনের পর কোন সরকারের শাসন আমলে সর্বোচ্চ পরিমান অর্থ পাচারের রেকর্ড।বাংলাদেশের অর্থ পাচারের তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান গুলো বলছে রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বজন তোষি নীতির কারনে গত দের দশকে কোন অর্থ পাচারকারীকে আইনের আওতায় আনা যায়নি। টাকা পাচার বন্ধে দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাণিজ্যিক ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং সিআইডি কাজ করছে। এরপরও দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। কারন হচ্ছে আইনের বাস্তব প্রয়োগের অভাব ছিল এবং এই সব প্রতিষ্ঠান গুলো ছিল অকার্যকর।
বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। গত বছরের জিএফআই এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা প্রতিবছর গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শুধু ব্যক্তি উদ্যোগেই নয়, অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকও।দেশ থেকে অর্থ পাচার প্রধানত তিনটি উপায়ে হয়ে থাকে-
এক. বাণিজ্য কারসাজি : এটি অর্থ পাচারের বড় একটি মাধ্যম। আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়।
দুই. হুন্ডি : দেশীয় আইন দ্বারা স্বীকৃত নয় এমন অপ্রাতিষ্ঠানিক পন্থায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ প্রেরণ পদ্ধতি মূলত হুন্ডি নামে পরিচিত।
তিন. চোরাচালান : অর্থ পাচারের এটিও একটি মাধ্যম।
মূলত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্য কমবেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের কাজটি করা হয়। বাণিজ্যের আড়ালে ও অর্থ পাচার হচ্ছে ব্যাপক ভাবে।বাণিজ্য ভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ওভার ও আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং আবার কখনো রপ্তনী আয় দেশের বাহিরে রেখে দিয়ে, হুন্ডি কিংবা চোরাচালানের মধ্য দিয়ে এই পাচার কার্য সম্পাদন হয়ে থাকে । এর বাইরে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের আওতায়ও টাকা পাচার হচ্ছে। পূর্বে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচারের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার হচ্ছে বেশি। পাচার করা টাকার একটি বড় অংশই যাচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও এ ঘটনা ধরা পড়েছে। বিশেষ শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানির নামে টাকা পাচার হয়েছে বেশি।
১০টি দেশ বা অঞ্চলেই বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। সর্বশেষ ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফিনান্স অব টেরোরিজম নামের কৌশলপত্রে (২০১৯-২০২১) গবেষণা ও অবৈধ অর্থ প্রবাহের ঘটনা থেকে দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রধান গন্তব্য ছিল দশটি দেশ বা অঞ্চল- সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত,অস্ট্রেলিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। মার্কিন নাগরিক ফরেস্ট কুকসন ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে এসেছিলেন আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির একজন কনসালটেন্ট হিসেবে। তিনি ২০১৮ সালে হুন্ডি নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি করেছিলেন। সেখানে তিনি মোটাদাগে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার পাঁচ ধরনের চাহিদার কথা বলেছিলেন। যেমন- আমদানিতে আন্ডার-ইনভয়েসের বার্ষিক চাহিদা ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা ক্রমেই বাড়ছে,বাংলাদেশে কর্মরত আছেন (মূলত বস্ত্র ও পোশাক খাতে) প্রচুর ভারত ও শ্রীলঙ্কান নাগরিক, যাঁরা নিজ নিজ দেশে বছরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাঠান, বাংলাদেশিদের পুঁজি পাচার হয় বছরে ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে (মূলত ভারতে) অর্থ পরিশোধ করা হয় বছরে ১ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের ঘাটতি পূরণের জন্য বছরে প্রয়োজন হয় ১-৩ বিলিয়ন ডলার। ফরেস্ট কুকসন আরও বলেছিলেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আন্ডার-ইনভয়েসের ঘটনা ঘটে, ভারতের ক্ষেত্রে তা ৪০-৪৫ শতাংশ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সব পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনবে কিভাবে? বাংলাদেশে অর্থের অবৈধ ব্যবহার নিয়ে আইন আছে এবং আইন যেটা আছে, সেটা একেবারে অপ্রতুল না। প্রথম আইনটির নাম ছিল মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২ (২০০২ সালের ৭ নম্বর আইন)। এ আইনের বিধানাবলী অপর্যাপ্ত থাকায় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করে (অধ্যাদেশ নম্বর ১২, ২০০৮) কিছু বিষয় যুক্ত করে। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অধ্যাদেশটি সংবিধানের অনুশাসন অনুযায়ী পরীক্ষা করে ২০০৯ সালে আইনে রূপান্তরিত করে। আইনটির শিরোনাম ছিল মানি লন্ডারিং আইন-২০০৯ (২০০৯ সালের ৮ নম্বর আইন)। ২০০৯ সালের আইনটিও পরে বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০১২ জারি করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ নামেই পরিচিত।এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট ও আছে, যাদের কাজ হচ্ছে, কোনো অস্বাভাবিক লেনদেন বা টাকা পাচারের তথ্য পেলে সেটার অনুসন্ধান করা। তারপর তারা যে রিপোর্ট দেয় সেটাকে ধরে দুদক বা সিআইডি।দীর্ঘদিন এই সংস্থা গুলো ও ছিল আকার্যকর ও সমন্বয়হীন।মূলত এটার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু তারা সেটা সঠিকভাবে করছে কিনা সেটা এখন খতিয়ে দেখা দরকার। বর্তমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর একজন প্রাজ্ঞ এবং দক্ষ অর্থনীতিবিদ, উনি গত দেড় দশকে এই ইস্যু গুলো নিয়ে খুবই সোচ্চার ছিলেন এবং রাষ্ট্রী পলিসি ম্যাকিং এ গুরুত্বপুর্ন পরামর্শ দিয়েছেন। এখন এই সমস্যা সমাধানের এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় সুযোগ উনার হাতেই আছে।তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ও এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। ২০১৩ জুলাই মাসে বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়েছিল। এগমন্টগ্রুপ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যারা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন-সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে।এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন দেশের একই ধরনের সংস্থার কাছ থেকে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও বিদেশে পাচার করা অর্থের তথ্য পেতে পারে এবং পেয়ে থাকে। কারা পাচার করছে, কি পরিমানপাচার করেছে ইত্যাদি। এই তথ্যগুলো নিয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিলে একটা ফলাফল আসবে বলে আমার বিশ্বাস। তাই অর্থপাচার রোধে একটা সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার এবং সাথে সাথে পাচারকৃত অর্থ কিভাবে ফেরত আনা যায় তার ব্যবস্থা গ্রহন জরুরী।স্বৈরশাসক হাসিনার আমলে এটি সম্ভব হয়ে উঠেনি কারন তখন কার্যকর কোন উদ্যোগ প্রহন করা হয়নি,কিন্তু এখন তো দেশপ্রেমিক একটি সরকার ক্ষমতায় আছে তাদের দ্বারা এই উদ্যোগ নেওয়া ও কার্যকর করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করার ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন এজেন্সি আছে।বিদেশের সঙ্গেও আমাদের বেশ কিছু নেটওয়ার্ক আছে।তাছাড়া আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস স্যারের ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক ও সম্পর্ককেও এই ক্ষেত্র কাজে লাগানো যেতে পারে।আমার বিশ্বাস দেশের ভেতরে বা বাইরে হোক দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করা হলে সেটা উদ্ধার করার সক্ষমতা আমাদের দুদকের ও আছে।তাই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ে সমন্বিত তদন্ত উইংকে শক্তিশালি করে অপরাধীদের সনাক্ত করা, প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠন করে পাচার করা অর্থ উদ্বারের ব্যবস্থা গ্রহন করা। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে, অর্থ পাচার যতটা সহজভাবে হয়েছে, সেই অর্থ ফিরিয়ে আনা ততটাই কঠিন থেকে কঠিনতর। তারপর ও আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টাএবং কেন্দ্রী ব্যাংকের গভর্নর এই ব্যাপারে আরেকটু বেশী মনোযোগী ও কৌশলী হলে পাচারকারীরা কেউ পার পাবে না বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
Email : msislam.sumon@gmail.com