মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩ অপরাহ্ন
রেডজোন ঘোষিত রাজধানীর ডেমরা
ব্যাটারিচালিত নিষিদ্ধ অটোরিকশা ও ইজিবাইকের দৌড়াত্ম্য
অভ্যন্তরীণ ও প্রধান সড়কের পাশে অবৈধ দখল : যানবাহন স্টেশন
অবৈধ দখল ও অটোরিকশা-ইজিবাইক সেক্টরে দৈনিক ও মাসিক হারে চাঁদাবাজি
সর্বত্রই মানা হচ্ছেনা সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি: নেই প্রশাসনের নজরদারি
করোনা পরিস্থিতিতেও থেমে দখলযজ্ঞ ও চাঁদাবাজি
রেডজোন ঘোষিত রাজধানীর ডেমরায় করোনা পরিস্থিতিতেও থেমে নেই দখলযজ্ঞ ও চাঁদাবাজি। ইতোপূর্বে কয়েক দফায় উচ্ছেদের পরও এখানকার অভ্যন্তরীণ ও প্রধান সড়কের দুই পাশ দখল করে অবৈধ দোকানপাট ও যাত্রীবাহী যানবাহন স্টেশন গড়ে উঠেছে।
এদিকে প্রশাসন ও ট্রাফিকের সামনেই ডেমরার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে দাবরে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত নিষিদ্ধ অটোরিকশা, ইজিবাইক ও মিশুক রিকশা। আর অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব দোকানপাট, যানবাহন স্টেশন অটোরিকশা-ইজিবাইক-মিশুক সেক্টর থেকে দৈনিক ও মাসিক হারে চাঁদা আদায় করছে একটি প্রভাবশালী মহল। আর এ বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি না থাকা বা সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। আরও অভিযোগ নজরদারি না থাকায় রেডজোন ঘোষিত ডেমরা এলাকার সর্বত্রই মানা হচ্ছেনা সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি। এলাকার গুরুত্বপূর্ন পয়েন্টসহ সর্বত্রই দেখা গেছে মানুষের বেপরোয়া অবাধ চলাচল।
এদিকে ট্রাফিক বিভাগের ইন্সপেক্টর (টিআই) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জনবল স্বল্পতায় অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে কোন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা থাকেনা। তবে অবৈধ যানবাহন ও সড়কের পাশে দখলযজ্ঞ ও চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রশাসন, ট্রাফিক বিভাগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, দলীয় নেতৃবৃন্দ ও সমাজ কর্তা-ব্যক্তিদের সমন্বয় খুবই জরুরী। কারণ অপরাধীরা এ সমাজেরই মানুষ কারও না কারও ভাই বন্ধু বা আত্মীয়। তাই সমন্বয় ভিত্তিক অভিযানের মাধ্যমে সমাজের সকল প্রতিবন্ধকতা ও অনিয়ম-অব্যস্থাপনা দূর করা সম্ভব।
প্রশাসন বিভাগের ডেমরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, অভ্যন্তরীণ ও প্রধান সড়কের দায়িত্ব ট্রাফিক বিভাগের। তবে সড়কে অব্যস্থাপনা ও অবৈধ দখল, যানবাহনের চাঁদাবাজি এ সকল অন্যায় কর্মকান্ডের বিষয়ে সমন্বয় ভিত্তিক পূর্ণ নজরদারি দেওয়া হবে। কিন্তু চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রশাসন বিভাগ অবগত না হলেও অভিযোগের ভিত্তিতে বা নজরদারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণসহ প্রতিরোধ করা হবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ডেমরার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট স্টাফ কোয়ার্টার, কোনাপাড়া বাজারসহ বড় ফার্মের মোড়, রানীমহল সংলগ্ন এলাকা, বড়ভাঙ্গা, ডগাইর এলাকা, অভ্যন্তরীণ খালগুলোর দুই পাড়, হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তাঘাট, বাঁশেরপুল এলাকা ও সারুলিয়া বাজারসহ সর্বত্রই অবৈধ রয়েছে দখলজজ্ঞ। ডিএনডির অভ্যন্তরীণ খালগুলোসহ প্রধান খালের উপরেও গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ দোকানাপাট। সড়কগুলোর পাশে ফুটপাতসহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) জায়গা দখল করে অবৈধ দোকানপাট ও বিভিন্ন অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। খালের ওপর ঝুলন্ত দোকান করে করোনা সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি এখন চাদা আদায়ের নতুন কৌশল। ডেমরার সর্বত্রই অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত অবৈধ তিন চাকার যানবাহন। আর অভ্যন্তরীণ প্রায় প্রতিটি সড়কের পাশেই চালকরা অবৈধভাবে পার্কিং করে রাখছেন ব্যাটারিচালিত এসব নিষিদ্ধ ইজিবাইক, অটোরিকশা ও মিশুক। এতে সড়কে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় যানজট ও প্রতিবন্ধকতা। এসব নিষিদ্ধ যানবাহনকে ঘিরে ডেমরায় চলছে লাখ লাখ টাকার টোকেন বাণিজ্য, দেনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক চাদাবাজি। এদিকে সড়কের পাশেই যাত্রীবাহি বাস পার্কিং নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে।
আরও দেখা গেছে, ডেমরা-রামপুরা সড়কের শুরুতেই এক পাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অবৈধ ছোট বড় দোকানপাট। পাশাপাশি রয়েছে সিনজি স্ট্যান্ডসহ অবৈধ অস্থায়ী নানা স্থাপনা। সড়কটির অপর পাশেই রয়েছে যাত্রীবাহী বিভিন্ন পরিবহনের বাসস্টপেজ। এক পাশে অবৈধ দোকানপাট, অপর পাশে যাত্রীবাহী বাসের স্টপেজ থাকায় সড়কটির মুখে সবসময় যানজট ও বিশৃঙ্খলা লেগে থাকে। স্থানীয় এক শ্রেণীর প্রভাবশালী সড়কের পাশে দোকানপাট ও স্থাপনা বসিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ বাণিজ্য। কোনাপাড়া বাজার, সারুলিয়া বাজার এলাকা, ডগাইর বাজার ও বড়ভাঙ্গা এলাকাসহ ডেমরার গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টেই অবৈধভাবে দোকানপাট বসিয়ে চলছে চাদাবাজি। এছাড়া ডেমরার সুলতানা কামাল সেতুর নিচের অবৈধ দখল দেখার যেন কেউ নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নতুন দোকান বসাতে প্রভাবশালীদের অনুমতিসহ বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে পজেশন নিতে হয় ভাড়া হিসেবে। সেই সঙ্গে রয়েছে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক চাঁদা। তবে হকার ও অস্থায়ী দোকান প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিতে হয় প্রভাবশালী নেতাদের। মাঝে মাঝে অপসারণ করা হলেও অজ্ঞাত কারণে ওইসব দোকানপাট পুনর্বহাল হয়ে যায়। অভিযোগ আছে- এসব দোকানপাটের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পাশাপাশি প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি। যাদের ব্যক্তিগত নানাবিধ সুবিধার জন্যই ডেমরায় এসব দখলযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারছেন দখলবাজরা। অন্যথায় প্রশাসনের নাকের ডগায় ওপেন দখলযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয় বলে মন্তব্য অভিজ্ঞমহলের।
আরও জানা যায়, এদিকে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বেলাও চলছে একই নিয়ম। অভ্যন্তরীণ প্রতিটি রুটে চলার অনুমতি হিসেবে প্রথমেই ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা গুনতে হয় চালকদের। আর মাসিক ৫০০ টাকা তো দিতেই হবে। সেই সঙ্গে পয়েন্ট ভেদে প্রতিদিনকার ৫০ থেকে ১০০ টাকা না দিলে সড়কে চলাচল নিষিদ্ধ। স্টাফ কোয়ার্টারের সিএনজির বেলাতে একই নিয়ম, তবে স্কুটার প্রতি মাসিক ৩৫০ টাকা দিলেই রাস্তায় চলা সম্ভব। এছাড়াও অবৈধ যানবাহনের গ্যারেজের চাদা নেওয়া বাদ পড়েনা। মোটা অংকের টাকা আসে ডেমরার অন্তত ৩০/৩৫ গ্যারেজ থেকে। এছাড়া ডেমরার অলিগলিসহ নিরিবিলি এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে অসংখ অবৈধ ছোট বড় কারখানা। এসব কারখানাগুলো যেন টাকার মেশিন। প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ টাকা মাসিক হারে চাদা ওঠে ওইসব কারখানা থেকে।
এদিকে প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় করোকালীন ডেমরার কোথাও সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি এবং হচ্ছেওনা। বিভিন্ন ছোট বড় মার্কেট,বিপনি বিতান কেন্দ্র, বাজার ঘাট ও সড়কে করো প্রতিরোধক এখনো কোন নিয়ম মানা হচ্ছেনা,এমনকি ডেমরার অনেক মানুষ বাইরে মাস্ক পর্যন্ত ব্যবসহার করছেনা। গায়ে গায়ে লেগে যাতায়াত ও চলাফেরা যেন স্বাভাবিক বিষয়। এছাড়া যাত্রীবাহী লেগুনা ও অন্যান্য যানবাহনেও অনিয়ম চলছে ওপেন। নজরদারি না থাকায় ডেমরায় এমন অসচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
এ বিষয়ে কোনাপাড়া এলাকায় বসবাসরত প্রফের হারুন-অর-রশিদ বলেন, করোনাকালীন ডেমরায় কোন নিয়ম মানা হয়নি বলেই এলাকাটি রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাছাড়া ডেমরায় চাদাবাজি ও দখলযজ্ঞ বহাল রাখতে অনিয়ম আরও ছড়িয়ে পড়েছে যা নিয়ন্ত্রণহীন। এক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে প্রশাসনের নজরদারি প্রয়োজন, অন্যথায় ডেমরার সর্বত্রই করোনা ভাইরাস ভয়াবহ রূপ নিবে।
মোছা. শিল্পি হায়দার নামে একজন শিক্ষিকা বলেন, জরুরী প্রয়োজনে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার, কোনাপাড়া ও হাজীনগর এলাকায় চলাচল করতে হয়। কিন্তু অবৈধ দখলযজ্ঞ ও নিষিদ্ধ যানবাহনের দৌড়াত্ম্যে রাস্তায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচল এখন দায় হয়ে পড়েছে। সর্বত্রই অনিয়ম-ীব্যস্থাপনা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর মানুষকে সচেতন করতে সরকারি কোনমহল ও প্রশাসনের তৎপরতা ডেমরায় নেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে ডেমরা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার রাকিবুল হাসান বলেন, ইতোপূর্বে ডেমরায় একাধিকবার হকার উচ্ছেদসহ অবৈধ দখলদারদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। সমন্বয়ভিত্তিক অভিযানও করা হয়েছে, যা অব্যাহত থাকবে। তবে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি আমার জানা নেই, আর দখলদার ও চাঁদাবাজদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পৃক্তা আছে তাও জানার বিষয় রয়েছে। আর এ জাতীয় অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিব। তাছাড়া এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েও যথাযোগৗ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। ডেমরায় অনিয়ম-অব্যস্থাপনা সবই সমন্বয়ভিত্তিক অভিযানে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।