রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪০ অপরাহ্ন
২০১৬ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ঢাকার বাস ও মিনিবাসের নির্ধারিত ভাড়া ছিল কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৭০ পয়সা; কিন্তু যাত্রীদের অভিযোগ ছিল নির্ধারিত রেটের চেয়েও বেশি ভাড়া আদায়ের। ‘গেটলক’ ও ‘লোকাল’ নামে কোনো কিছু ছিল না ভাড়াবিষয়ক প্রজ্ঞাপনে। কিন্তু ‘গেটলক’ বা ‘সিটিং’ সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানোর ফলে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া নির্ধারিত হয় দুই টাকা ৭২ পয়সা। এখন পর্যন্ত কিলোমিটারপ্রতি দুই টাকা ৭২ পয়সা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। কিন্তু এর আগে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল সাত টাকা। তবে লোকাল সার্ভিসে এটি ছিল পাঁচ টাকা। কিন্তু এখন লোকাল বাসেও সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনে রাজধানীর ভিআইপি সড়ক, প্রগতি সরণি ও মিরপুর রোডসহ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রতিটি রুটেই বেড়েছে যাত্রীর চাপ। অফিস সময়ের আগে ও পরে চাপ বেশি দেখা গেছে। এই সময়ে বাসগুলোর সব সিট যাত্রীতে পূর্ণ থাকে। এরপর দাঁড় করিয়েও নেওয়া হয়েছে যাত্রী। কিন্তু বেশি ভাড়াও ঠিকই নেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বেশ কয়েকটি রুটে গণপরিবহনে সরকার ঘোষিত ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোনো ধরনের নিয়ম মানার প্রবণতা চোখে পড়েনি। নগরীর ১ নম্বর রুট কালুরঘাট থেকে কোতোয়ালি মোড় পর্যন্ত হিউম্যান হলারে (মিনিবাস) যাত্রীপ্রতি ভাড়া আগে ১৩ টাকা থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে আদায় করা হচ্ছে ২৫ থেকে ২৬ টাকা। ৮ নম্বর রুটে অক্সিজেন থেকে লালদীঘির পার পর্যন্ত বাসভাড়া ছিল ১০ টাকা। কিন্তু এখন নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা। অক্সিজেন থেকে বায়েজিদ বোস্তামী টেম্পোভাড়া পাঁচ টাকার স্থলে এখন ১০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। সকাল সোয়া ১০টার দিকে বায়েজিদ বোস্তামী পেট্রল পাম্পের বিপরীত পাশে টেম্পো থেকে নামা এক যাত্রীর কাছ থেকে ১০ টাকা ভাড়া রাখা হলো। দ্বিগুণ টাকা কেন নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে চালক নিস্পৃহ কণ্ঠে বলেন, ‘ভাড়া আগে পাঁচ টাকা ছিল, এখন ১০ টাকা।’ এ সময় জয়নাল আবেদিন নামের ওই যাত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার বলেছে গাড়িতে অর্ধেক যাত্রী নিতে। ভাড়া ৬০ শতাংশ বেশি নিতে বললেও তারা তো আরো ৪০ শতাংশ বেশি নিচ্ছে। একজনের সঙ্গে একজন লেগেই বসতে হচ্ছে। ভাড়াও বেশি।’ ৪ নম্বর রুটের ভাটিয়ারী থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত বাসে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ছিল ১০ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা।
এভাবে মিনিবাস, হিউম্যান হলার, টেম্পোসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া নিচ্ছেন মালিক-শ্রমিকরা। চট্টগ্রামের অন্য সড়কগুলোতেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। মোটকথা করোনা পরিস্থিতির সুযোগে ভাড়া নিয়ে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। একটি রুটেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা দেখা যায়নি। পরিবহন মালিক, চালক ও সহকারীদের কাছে বন্দরনগরীর কয়েক লাখ যাত্রী জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ থেকে তাদের রক্ষার কেউ নেই যেন। আর রাজধানী ঢাকার অবস্থাও প্রায় একই। উত্তরা থেকে এয়ারপোর্ট হয়ে কুড়িল বিশ্বরোডে আসা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকায় ভাড়া একবার বাড়লে তা আর কমে না। করোনার সময় যাত্রী কম ছিল, বাসে স্যানিটাইজারও দেওয়া হতো। কিন্তু এখন কিছুই নেই। দাঁড় করিয়ে যাত্রী এনেছে, এর পরও বিকাশ পরিবহনের বাসটি ১০ টাকার বদলে ১৬ টাকা ভাড়া নিয়েছে।’
জিয়াদুল ইসলাম নামের এক যাত্রী বলেন, ‘বাসাবো থেকে বসুন্ধরা গেটে আসতে অন্য সময় ২০ টাকা ভাড়া দিতাম। এখন ৩০ টাকা দিতে হচ্ছে। বেশি ভাড়া দেওয়ার পরও উপচে পড়া ভিড় থাকে বাসে।’
আগের মতো স্বাভাবিক রেটে ভাড়া দিতে চাইলে কন্ডাক্টর-হেলপারদের হাতে অপমান-অপদস্থ হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছে যাত্রীরা। আগের রেটে ভাড়া দিতে চাইলে গালাগাল করা ছাড়াও আপত্তিকর মন্তব্যসহ যাত্রীকে বাস থেকে নামিয়ে দিতে তৎপর হয় কন্ডাক্টর-হেলপাররা।
রামপুরা এলাকায় অনাবিল পরিবহনের একটি বাস থেকে নামা যাত্রী সবুজ মিয়া বলেন, ‘বাসের লোকজনের নেচার খারাপ। বেশি ভাড়া নিব, কিছু কওয়াও যাইব না। কইতে গেলে গালিগালাজ করে। আর প্যাসেঞ্জারের মধ্যে কোনো মিল নাই। মিল থাকলে এগুলা করতে পারতো না।’
সম্প্রতি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে তারা সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আদায় করছে।’ বিআরটিএর মতে, ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল বাস মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না—এ ধরনের অভিযোগ আসায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানার আওতায় আনা হচ্ছে বাসকে। তবে ভাড়া কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ ব্যাপারে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া সব বিভাগীয় কমিশনারকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কঠোর হওয়ার জন্য। প্রতিদিন বহু মামলা করছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। এর পরও অভিযোগ আসছে। তবে আমরা আরো কঠোরতা অবলম্বন করব। ৬০ শতাংশ ভাড়া রহিত করার বিষয়ে এখনো আলোচনা হয়নি।’