টানা ৫ মাস হয়ে গেল করোনার তাণ্ডব চলছে দেশে। এ পর্যায়ে এখন প্রতিটি দিন ফুরোচ্ছে লাখো মধ্যবিত্ত মানুষের দীর্ঘশ^াস ছাড়ার মধ্য দিয়ে। মহামারি করোনায় সবচেয়ে মহা বিপাকে পড়েছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই। চাকরি চলে যাওয়া, আয় কমে যাওয়া ও বেতন না পাওয়াসহ নানা কারণে মধ্যবিত্তের মাঝে এখন চাপা কষ্ট ও নিরব কান্না। পেট চালাতে তারা ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। আবার কেউ দিচ্ছেন সঞ্চয়ে হাত।
করোনার কারণে সব শ্রেণী-পেশার মানুষেরই আয় কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লেগেছে ওই মধ্যবিত্ত পরিবারে। সম্প্রতি ব্র্যাক, ডেটা সেন্স ও উন্নয়ন সমন্বয় পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় দেশের মানুষের পারিবারিক উপার্জন ৭৪ শতাংশ কমে গেছে। তা ছাড়া এ হারে আয় কমা পরিবারের হারও ৭৪ ভাগ। অর্থাৎ করোনার আগে যে পরিবার ১০০ টাকা আয় করত এখন করছে মাত্র ২৬ টাকা। আর এই পরিবারগুলোই হচ্ছে নিম্ন আয়ের ও মধ্যবিত্ত পরিবার।
মধ্যবিত্তের জন্য যেমন নেই সরকারি কোনো আর্থিক বা খাদ্য সহায়তার প্যাকেজ, তেমনি তারা মান-সম্মানের ভয়ে কারো কাছে হাত পাততেও পারেন না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসিন্দা মো. সহিদুল ইসলাম। ৪০ হাজার টাকার মাসিক বেতনে তিনি ম্যানেজার পদে চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তার এই আয়েই চলে ৫ জনের সংসার। কিন্তু গত মাস বেতন দিতে পারেনি তার প্রতিষ্ঠান। ঢাকা শহরে টিকে থাকার মতো তার বিকল্প কোনো আয়ের রাস্তা নেই। প্রথম মাস কোনো রকম টেনেটুনে চালালেও শেষ দুই মাস অর্থাৎ জুন ও চলতি জুলাই মাসে তিনি আর পেরে ওঠেননি। বাধ্য হয়ে তিনি তার সঞ্চয়ে হাত দিয়েছেন। একটি বেসরকারি ব্যাংকে দশ বছর মেয়াদি ডিপিএস খোলা ছিল, কিন্তু দুই বছর না যেতেই সেটি তিনি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হলেন।
কালের খবরকে তিনি বলেন, স্বল্প বেতনের চাকরি। অনেক কষ্ট করে ডিপিএসটি চালাতাম। কিন্তু করোনার কারণে সেটি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হলাম। আসলে করোনা এসে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন কঠিন করে তুলেছে।
মধ্যবিত্তদের সংজ্ঞা সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে, দেশে তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে মধ্যবিত্তদের মাসিক আয় ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। তবে এটি শুধু বেতনের মাধ্যমে আয় হতে হবে, এমন নয়। যেকোনোভাবে আয় করে যারা এ ধরনের একটি সামাজিক মর্যাদা তৈরি করেছেন, তারাই মধ্যবিত্ত। এক্ষেত্রে শিক্ষার হার বিবেচনা এবং গ্রাম ও শহরে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে মধ্যম আয়ের লোকের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে প্রায় ৮০ লাখ।
আরেক মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা জয়নাল আবেদীন চাকরি করতেন একটি বহুজাতিক গার্মেন্টস কারখানায় অপারেশনার ম্যানজোর পদে। বেতনও পেতেন বেশ ভালো। কিন্তু গত মে মাসে ঢাকার আশুলিয়ার ওই গার্মেন্টস কারখানাটি কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। একদিনে বেকার হন তিনিসহ প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তিন মাস হতে চললো কারখানা মালিক এখনও তাদের পাওনা টাকা দেননি। তিন সন্তান, স্বামী-স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে তার ৬ জনের সংসারে এখন ঘোর অন্ধকার। ঢাকার কল্যাণপুরের তিন রুমের ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। চাকরি আছে-কি নাই, সেটি বাড়িঅলা বুঝতে চান না, মাস শেষে বাড়ি ভাড়ার টাকা তিনি ঠিকই বুঝে নেন। কিন্তু চাকরি নেইÑ বেতন নেই টাকা আসবে কোথা থেকে। তাই ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তিনি ভেঙে ফেলেছেন।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে
কালের খবরকে বলেন, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সরকার গত ২৫ মার্চ থেকে যখন টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ঘোষণা করল, তখনই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বড় ধাক্কা খায়। সে ধাক্কা তারা আজো সামলে উঠতে পারেননি। এখন হয়তো সরকার সবকিছু খুলে দিয়েছে, কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সংকট এখনও কাটেনি, বরং আরও বেড়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কবে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবে সেটি বলা মুশকিল।
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যে সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেছে সেটি বোঝা যায় সঞ্চয়পত্র তুলে নেওয়ার হারের দিকে তাকালে। এমনিতে গত কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছিল। ওই বিক্রিতে লাগাম টানতে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বেশ কিছু শর্ত ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। ফলে কিছুটা কমতির দিকেই ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। সম্প্রতি করোনা মহামারিতে সঞ্চয় তো দূরের কথা উল্টো সঞ্চয় তুলে নিচ্ছেন অনেক গ্রাহক। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত মে মাসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
একক মাস হিসেবে চলতি বছরের মে মাসে মোট ৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ২ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার। মাসটিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৪৩০ কোটি টাকা। সুতরাং খাতটিতে বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয় তুলে নেওয়ার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন এ বিষয়ে
কালের খবরকে বলেন, করোনা যতো দীর্ঘস্থায়ী হবে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কষ্ট ততো বাড়বে। কারণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত আর্থিক খাত ব্যাংক-বীমা থেকেও এখন অনেকের চাকরি চলে যাচ্ছে। ব্যয় কমাতে ব্যাংকগুলো কর্মী ছাঁটাই করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন তারা সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। সুতরাং এই শ্রেণীর মানুষের কষ্ট সহজে কমবে না। বেঁচে থাকার তাগিদে হয়তো অনেকেই গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে গিয়েও তো তারা আর্থিক দৈন্য থেকে রেহাই পাবেন না। কারণ গ্রামে গিয়ে এসব লোক না পারবেন কৃষি কাজ করতে, না পারবেন হুট করে কোনো ব্যবসা করতে।
তিনি বলেন, সুতরাং এ অবস্থায় তাদের আয় বাড়াতে করোনার পরিস্থিতি উত্তরণ জরুরি। তাই করোনা নিয়ন্ত্রণকে সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এর আগে তাদের টিকে থাকার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নগদ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া চাকরিহারাদের তালিকা করে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেটি হতে পারে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া কিংবা কৃষি খামার বা গবাদি খামার করতে সহায়তা দেওয়া।