গ্রামের বাড়ি তার বাগেরহাট জেলার কার্ত্তিকদিয়া গ্রামে। এইচএসসির পর পড়াশোনার জন্য চলে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পড়ার পর স্নাতকোত্তর করেন ঢাকার ইডেন কলেজে। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পাশাপাশি চলে আইন নিয়ে পড়াও। আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে। এরমধ্যে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে চাকরি শুরু করেন। পাঁচ বছর চাকরি করার পর ছেলে সন্তানের জননী হন। ছোট ছেলে নিয়ে চাকরি করা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না তার। ছেড়ে দেন। এরপর ছেলেকে নিয়েই কাটে দিন। সঙ্গে টুকটাক লেখালেখি করতেন বাসায় বসেই। ইতোমধ্যে ঝুমকি বুঝতে পারেন সংসার-সন্তান সামলে বাসার বাইরে গিয়ে চাকরি করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠবে না। কিন্তু মনে মনে একটা কিছু করার খুব ইচ্ছে অনবরত নাড়া দিতে থাকে। ছেলে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। বড় হতে থাকে মনের সুপ্ত ইচ্ছেটাও। একদিন বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে কিছু কাঠের নকশা আর রং কিনে আনেন। ভাবেন সামনে ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিজের হাতে তৈরি করা গয়না পরবেন। বানিয়েও ফেললেন। পরার পর ওই অনুষ্ঠানে পেলেন সবার প্রশংসা। সাহস সেদিন আরও বেড়ে গেল। পরের দিন ফেসবুকে একটা পেজ খুলে ফেললেন। জন্ম নিলো ‘রূপসা’ ।
প্রথমে কাজ শুরু করেন হাতে তৈরি বিভিন্ন গয়না দিয়েই। এরপর নিজে ডিজাইন করে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ব্লাউজ পিস, বাচ্চাদের শাড়িও করতে শুরু করলেন। অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি মেলাতে অংশ নিয়েও ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন তিনি। তার স্বপ্ন রূপাসা’র পণ্য দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও দাপিয়ে বেড়াবে।
চাকরি না করে ব্যবসা কেন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে মেয়েদের জন্য চাকরি করা যে কত কষ্টের তা আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি। পারিবারিক সাপোর্ট না থাকলে সন্তান মানুষ করার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্যবসা আমার নিজের। আমি আমার কাজের জন্য সবকিছু ম্যানেজ করে ঠিকই সময় বের করে ফেলতে পারি। এখানে তো কোনো সময়ের সীমাবদ্ধতা নেই। তাই আমি ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আমার বিভিন্ন প্রোডাক্ট রেডি করি, ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে ব্যবসার কাজ করি। মোটকথা আমি আমার মতো করে সময়টা বের করে নিচ্ছি। যে সুযোগ চাকরিতে নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিজে নিজে কাজ করার পাশাপাশি কয়েকটা প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এটা জরুরি। প্রশিক্ষণে অনেক বিষয় জানা যায়। ছোট ছোট ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে নেওয়া যায়।’
‘সত্যি বলতে কি, ব্যবসার কথা যখন পরিবারের সদস্যরা প্রথম জানলেন, সবাই একদম অবাক হলেন। তাদের খুব একটা সাপোর্ট ছিল না। তারপরেও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে চলি।’ যোগ করেন ঝুমকি।
পরিবারের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মা প্রথমে শুনেই বললেন এত পড়ালেখা করে শেষে তুই গয়না বানাবি? খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু দমে যাইনি। এরপর পূজার সময় আমি নিজে ডিজাইন করে বাড়ির সবাইকে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ব্লাউজ, গয়না বানিয়ে দিলাম। সেটা দেখে পরিবারের সবাই খুব প্রশংসা করলেন। আশেপাশের মানুষদেরও সমাদর পেলাম। আমার ফেসবুক পেজের চাপও বাড়তে লাগলো। তখন আমার মা-সহ পরিবারের সবাই বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। আমার স্বামীও এখন আমার বিভিন্ন কাজে সাহায্য করেন। ছেলে সব কাজ খুব উৎসাহ নিয়ে দেখে।’
নারীদের উদ্যোক্তা হতে হলে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। উদ্যোক্তা হিসেবে বর্তমানে তার নিজের অবস্থান কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রূপসা আমার সন্তানের মতো। আমি নিজের অবস্থানে খুব খুশি। কিন্তু সবাই চায় তার সন্তান আরও বড় হোক, আরও নাম করুক। তেমনি আমিও চাই আমার রূপসা আরও এগিয়ে যাক। অনেকেই বলে রূপসা কি আমার মেয়ের নাম? আমি বলি হ্যাঁ, রূপসা আমার মেয়ে। আমার মেয়ে রূপসাকে আমি প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছি পরম মমতায়। আজ যেমন রূপসাকে সবাই পছন্দ করে, ভালোবাসে— সে সুনাম যেন সবসময় থাকে, সেটা আমি মাথায় রাখি।’
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তা হতে হলে অনেক নেগেটিভ কথা শুনতে হয়। বিশেষ করে প্রথম দিকে। কিন্তু সেসব শুনে পিছিয়ে পড়লে বা মন খারাপ করলে চলবে না। নিজের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে নিজের মতো করেই। ধৈর্য ধরে ভালো কাজ করে যেতে পারলে সফলতা আসবেই।