সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২৯ পূর্বাহ্ন
রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদ বের হবে। তার সঙ্গে থাকবে মুসা (আ.)-এর লাঠি এবং সুলায়মান (আ.)-এর আংটি। ঈমানদারদের কপালে মুসা (আ.)-এর লাঠি দিয়ে নুরানি দাগ টেনে দেবে…
কেয়ামতের বড় আলামতসমূহের একটি হচ্ছে দাব্বাতুল আরদ বা অদ্ভুত এক প্রকার প্রাণীর উদ্ভব। পৃথিবীর শেষ সময়ে এটি প্রকাশিত হবে। হজরত হুজায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ দশটি নিদর্শন তোমরা দেখতে না পাবে (যথা) পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া, ধোঁয়া বের হওয়া, দাজ্জালের আবির্ভাব, মারিয়াম তনয় ঈসার আগমন, ভূগর্ভ থেকে জন্তু বের হওয়া…।’ (মুসলিম : ২৮৯৯; মুসনাদে আহমাদ : ৩৬৪৩)। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে দাব্বাতুল আরদ সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো।
দাব্বাতুল আরদের পরিচয়
আরবিতে ‘দাব্বাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্তু বা প্রাণী, যা জমিনে পা ফেলে চলাচল করে। আর ‘আরদ’ অর্থ হচ্ছে ভূমি, ভূপৃষ্ঠ বা ভূগর্ভ। কেয়ামতের আগে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে অদ্ভুত ধরনের একটি প্রাণী বের হবে এবং পুরো পৃথিবীতে বিচরণ করবে। এটিকে কেয়ামতের বড় আলামতের একটি গণ্য করা হয়। হাদিসে এসেছেÑ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেনÑ ‘ওই সময় আসার আগ পর্যন্ত কেয়ামত কায়েম হবে না, যতদিন না পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের ঘটনা সংঘটিত হবে। পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের ঘটনা ঘটার পর মানুষ দাব্বাতুল আরদ দেখতে পাবে।’ (বুখারি : ৪৬৩৬; মুসলিম : ১৫৭)। ‘দাব্বাতুল আরদ’ প্রাণীটির নাম নয় বরং অদ্ভুত প্রাণীটির প্রসঙ্গে কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ, যার অর্থ ‘ভূগর্ভস্থ প্রাণী’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন প্রতিশ্রুতি (কেয়ামত) সমাগত হবে, তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি প্রাণী বের করব। সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে।’ (সুরা নামল : ৮২)
দাব্বাতুল আরদ বের হওয়ার সময়কাল
কেয়ামতের বড় বড় কয়েকটি আলামত ঘটে যাওয়ার পর এক বছর জিলহজ মাসের কোরবানির ঈদের দিবাগত রাত এত দীর্ঘ হতে থাকবে যে, সফররত ব্যক্তিরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়বে, শিশু-বাচ্চারা ঘুমাতে ঘুমাতে ক্লান্ত হয়ে জেগে উঠবে, গবাদি পশুরা চরণভূমিতে বের হতে ছটফট শুরু করবে, লোকেরা ভয়ে ও আতঙ্কে চিৎকার করে কান্নাকাটি ও দোয়া-তওবা করতে থাকবে। এভাবে তিন-চার দিন সময় পরিমাণ দীর্ঘ রাতের অবসান ঘটিয়ে চন্দ্রগ্রহণের মতো টিমটিমে আলো নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবে। এই নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার পর পৃথিবীর সব মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং তাওবা করবে। কিন্তু তখন ঈমান ও তওবা আর কবুল করা হবে না। (ফাতহুল বারি : ১১/৩৫৩)। আকাশে আলো ফোটার পর মানুষ যখন বাইরে বের হবে তখন দুপুরের দিকে কাবা গৃহের পূর্ব দিকে অবস্থিত সাফা পাহাড় ভূমিকম্পে ফেটে যাবে। তখন সেখানকার জমিনের ভেতর থেকে দাব্বাতুল আরদ বের হবে। (মুসলিম : ২৯৪১)
দাব্বাতুল আরদের আকৃতি
‘দাব্বাতুল আরদ’ বা অদ্ভুত প্রাণীটির আকৃতি প্রসঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন হাদিসে আলোচনা এসেছে। সেসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর ভেতর অনেক প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। অদ্ভুত এই প্রাণী কিছুটা উটের মতো হবে। পা হবে চারটি। মাথা হবে ষাঁড়ের মতো। চোখ হবে শূকরের মতো। কান হবে হাতির মতো। নাক হবে উটপাখির মতো। বুক হবে সিংহের মতো। রঙ হবে নেকড়ের মতো। কপাল হবে ভেড়ার মতো। ঘন পশমবিশিষ্ট হবে। মানুষের মতো চেহারা হবে। (ফাতহুল কাদির: ৪/১৫২; আদ-দুররুল মানসুর : ৬/৩৭৮)। সে পুরো পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করবে এবং সব মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তাদের ওপর নির্দেশ পতিত হবে (পূর্ব দিক থেকে সূর্য না উঠে পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া) তখন আমি তাদের জন্য দাব্বাতুল আরদ বের করব। সে সবার সঙ্গে কথা বলবে। সে সবার কাছে গিয়ে বলবেÑ লোকেরা আমার নিদর্শনসমূহে বিশ^াস করত না!’ (সুরা নামল : ৮২)। আরও বিভিন্ন হাদিসে এসেছে, সে মানুষকে তাকওয়া, তাওয়াক্কুল, আল্লাহর ভয় প্রভৃতি বিভিন্ন সদুপদেশ দিতে থাকবে।
দাব্বাতুল আরদের কাজ
ঈমান আনয়ন ও তাওবা কবুলের দরজা যে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছেÑ এ বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সে মুমিনদেরকে কাফের থেকে নির্দিষ্ট চিহ্নের মাধ্যমে আলাদা করে ফেলবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদ বের হবে। তার সঙ্গে থাকবে মুসা (আ.)-এর লাঠি এবং সুলায়মান (আ.)-এর আংটি। ঈমানদারদের কপালে মুসা (আ.)-এর লাঠি দিয়ে নুরানি দাগ টেনে দিবে। ফলে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আর কাফেরদের নাকে সুলায়মান (আ.)-এর আংটি দিয়ে দাগ লাগাবে। ফলে তাদের চেহারা অনুজ্জ্বল হয়ে পড়বে। তখন অবস্থা এমন হবে যে, কোনো খাবারের টেবিল ও দস্তরখানায় কয়েকজন মানুষ বসলে প্রত্যেকেই একে অপরের ঈমান ও কুফুরির বিষয়টি স্পষ্ট দেখতে পাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৭৯২৪)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদ বের হবে এবং মানুষের নাকে চিহ্ন দিবে। তারপরও মানুষ পৃথিবীতে জীবনযাপন করবে। প্রাণীটি সকল মানুষের নাকেই দাগ লাগিয়ে দিবে। এমনকি উট ক্রয়কারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তুমি এটি কার কাছ থেকে ক্রয় করেছ? সে বলবেÑ আমি এটি নাকে দাগ লাগানো অমুক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করেছি।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৩২২)। দাব্বাতুল আরদের এই কাজ শেষ হওয়ার পর অদৃশ্য হয়ে যাবে।
দাব্বাতুল আরদের পরের অবস্থা
দাব্বাতুল আরদের অন্তর্ধানের পর আল্লাহ তায়ালা ইয়েমেনের দিক থেকে রেশমের মতো মোলায়েম একটি বাতাস প্রবাহিত করবেন। যার অন্তরে সামান্য পরিমাণও ঈমান থাকবে তার শরীরে এই বাতাস স্পর্শ করবে। ফলে সব ঈমানদার ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়ে যাবে। তারপর পৃথিবীতে কেবল নিকৃষ্ট লোকেরা থাকবে। তাদের ওপর কেয়ামত কায়েম হবে। (মুসলিম : ১১৭, ১৯২৪)। অন্য হাদিসে এসেছে, পৃথিবীতে তখন শুধু নিকৃষ্ট আর পাপাচারী লোকেরা থাকবে। তাদের জীবনযাত্রা অত্যান্ত সুখময় হবে। পাখির মতো ক্ষিপ্রতা থাকবে তাদের। পশু-পাখির মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। কোনো কল্যাণকর কাজ তারা করবে না। কেউ কোনো মন্দ কাজ করলে বারণ করবে না। তখন শয়তান তাদের সামনে মানুষের আকৃতিতে এসে বলবে আমি তোমাদেরকে যা করতে বলব তোমরা কি তা করবে না? লোকেরা বলবে, তুমি আমাদেরকে কী করতে বল? তখন শয়তান তাদেরকে মূর্তিপূজার আদেশ করবে। সে যুগে মানুষের প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর শিঙ্গায় ফুক দেওয়া হবে। (মুসলিম : ২৯৪০)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় ও দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাবের পর পৃথিবী আর একশ বিশ বছর অবশিষ্ট থাকবে। (ফাতহুল বারি : ৩৬১)