শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৩ অপরাহ্ন
নাটোর, কালের খবর :
নাটোরের নারদ নদ একসময় ছিল খরস্রোতা। কিন্তু মানুষের নিষ্ঠুরতায় সে নদ এখন মারা যাওয়ার পথে। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য, দখলবাজি, ভরাট ইত্যাদি কারণে এ নদ পরিণত হয়েছে সরু খালে।
প্রবীণ লোকজন জানান, নারদ নদকে ঘিরে প্রায় তিনশ বছর আগে নাটোর শহরের গোড়াপত্তন হলে মানুষের মাঝে সে সময় প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হয়।
বিগত ১৭০৬ সালে নাটোরের রাজা রামজীবন ও রঘুনাথ এখানেই তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। বাংলার তখনকার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গেও গড়ে ওঠে নাটোরের যোগাযোগ। সে সময় খরস্রোতা এ নারদ নদই ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল।
এ নদের দুই ধারে গড়ে ওঠে নগর, গ্রামগঞ্জ ও বসতি। নদই ছিল নাটোরের প্রকৃতি, জীববৈচিত্য ও মানুষের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে র কেন্দ্রস্থল। সে সময় নদের বুকে চলত পাল তোলা নৌকা আর পণ্য বোঝাই স্টিমার। নদের স্বচ্ছ পানিতে প্রচুর মাছও পাওয়া যেত। নারদের স্বচ্ছ পানি ও নির্মল বাতাস সে সময়ে দুই পাড়ের মানুষের স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের সন্ধান জুগিয়েছে।
এ নদ নিয়ে লেখা বইয়ের লেখক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, নারদ বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটি নদ। এ নদের দুই তীরে অবস্থিত নাটোর শহর থেকে এক সময় রাজশাহী অঞ্চলের শাসনকার্য নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৮২১ সালে পদ্মা নদীতে বন্যায় ব্যাপক জলস্ফীতি হলে উৎসমুখে বালি ও পলি জমে নারদ স্রোতহীন হয়ে পড়ে। সেবারের বন্যায় দীর্ঘদিন নাটোর জলাবদ্ধ হয়ে থাকায় রাজশাহী অঞ্চলের সদর দফতর নাটোর থেকে রাজশাহীতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১৮২৫ সালে স্থানান্তর করা শেষ হয়। ১৮২১ সাল থেকেই নারদ নদের রাজশাহী অঞ্চলের প্রবাহটি মরা নদে পরিণত হতে শুরু করে।
রাজশাহী জেলার চারঘাটে পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদীর জন্ম হয় এবং বড়াল থেকে জন্ম হয় মুসাখাঁ নদীর। নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়ায় মুসাখাঁ নদী থেকে নারদ আবার পদ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালে চারঘাটে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি স্লুইসগেট তৈরি করার পর পরই নারদ মৃত নদে পরিণত হতে শুরু করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় নদতীর ভরাট করে শুরু হয় দখল প্রক্রিয়া। গড়ে তোলা হয় স্থায়ী ও অস্থায়ী বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো। এতে কমতে থাকে নারদ নদের আয়তন। নাটোরের ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নারদ নদ অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন সদর উপজেলার হাশিমপুর, সাধুপাড়া, মোহনপুর, পীরগঞ্জ ও কসবা গ্রামে নারদের ওপর ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কালভার্ট রয়েছে। ওইসব কোনো কালভার্ট দিয়েও আর পানি চলাচল করতে পারছে না। সদর উপজেলার কাফুরিয়া ইউনিয়নের লোটাবাড়িয়া গ্রামে নারদের ওপর মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করেছেন স্থানীয় লোকজন। নারদে পানি ঢোকার পথে চারঘাটে স্লুইসগেটের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি প্রতিবন্ধক রয়েছে। এদিকে এ নদটি খননের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটও করা হয়েছে। খননের মাটি পাড়ে ফেলে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বহু অবৈধ স্থাপনা। কলকারখানার দূষিত বর্জ্যরে দুর্গন্ধে নদের পাড়ের মানুষদের জীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় নদ সংস্কার, অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং দূষিত বর্জ্য ফেলা বন্ধের দাবিতে ফুঁসে আছেন নাটোরবাসী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশ কুমার জানান, নারদ নদ পুনঃখননের জন্য একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে নারদ নদে পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ জানান, নাটোর পৌর এলাকার ছয় কিলোমিটারের মধ্যে অবৈধ দখলকারীদের তালিকা প্রস্তুত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রাথমিক একটি তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। অল্প দিনের মধ্যে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।