রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন
আওরঙ্গজেব কামাল, কালের খবর :
ঢাকাসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সক্রিয় । গোটা সমাজ হুমকির মুখে । নানা বিধ অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা । হত্যা, সন্ত্রাসী হামলা, চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি ও মাদক গ্রহণ ছাড়াও তারা চুরি ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। তারা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের তারা উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানি করছে। গ্রেফতার হলেও আইনের দুর্বলতার কারণে আদালত থেকে তারা দ্রুত ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। জামিনে বেরিয়ে তারা আবারও একই অপরাধে জড়াচ্ছে। ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যাকান্ডসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে গোটা সমাজ কে হুমকির মুখে ফেলেছে। এদের বিরদ্ধে কথা বলার কোন উপায় নেই। এদের মধ্যে ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছে। তারা তুচ্ছ ঘটনায় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। পাড়া-মহল্লায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া, তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদকসেবনসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে গ্যাং সদস্যরা। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র বা নারীঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটাচ্ছে হত্যাকান্ড। জমি দখল এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রভাবশালীরা ব্যবহার করছেন গ্যাং সদস্যদের। পুরো দেশ জেুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কারনে অকারনে চা পাতি,দামদাও এবং লাঠি নিয়ে মহড়া দিতে দেখা য়ায়। এসব কিশোর-তরুণ দেশের বাইরে থেকে আনছে লেটেস্ট স্টেজ অব ড্রাগ (এলএসডি)। এ ড্রাগ সেবনের পর নিজের মনে একধরসের শিহরণ জাগছে। শিহরণরত অবস্থায় তারা যা ইচ্ছা তা-ই করছে। যেন শেষ নেই তাদের অপকর্মের। একপর্যায়ে নেশা গ্রস্ত হয়ে আত্মহননের পথও বেছে নেয় কেউ কেউ। তথ্য মতে রাজধানীর ৫০টিসহ সারাদেশে সক্রিয় ৫ শতাধিক গ্যাং সদস্য সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয় হাজার সদস্য রয়েছে। রাজধানী ঢাকাতে যেসব কিশোর গ্যাংয়ের নাম রয়েছে তার মধ্যে এক সময় পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গাল গ্যাং, লাগবি নাকি, মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, বিহারি রাসেল গ্যাং, বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু, সাইফুলের গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, বাবু রাজন গ্যাং, রিপন গ্যাং, মোবারক গ্যাং, নয়ন গ্যাং, তালাচাবি গ্যাং, নাইন এম এম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, স্টার বন্ড গ্রুপ, মোল্লা রাব্বির গ্রুপ, গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপায়ইয়া দে, শাহীন-রিপন গ্যাং, নাজিম উদ্দিন গ্যাং, শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, সোলেমান গ্যাং, রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং, বাংলা ও লাভলেট গ্যাং, জুম্মন গ্যাং, চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু, ভা-ারি গ্যাং, টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত গ্যাং যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। কেবলমাত্র রাজধানীতে ৫০টির বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। প্রতিটি গ্যাংয়ে সদস্য রয়েছে ১৫ থেকে ২০ জন করে। এই গ্যাং উত্তরা, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান, টঙ্গী, সূত্রাপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, আগারগাঁও ও হাতিরঝিলে সক্রিয়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া থেকে শুরু করে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণকারীদের ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। দেশের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। অপরাধ বিশ্লেষজ্ঞরা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনোখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহারের ঘটনাও ঘটছে। র্যাব সূত্রে জানা যায়, বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মদদ রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় নিজের অস্তিত্ব বা প্রভাব জাহিরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কা- ঘটায়। যেমন-উচ্চ শব্দে গান বাজানো, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, পথচারী ও কিশোরী-তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা এবং তুচ্ছ ঘটনায় সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়ে বড় ধরনের অপরাধ ঘটানো। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ঢাকায়। পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অপরাধীচক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বেশির ভাগ থাকে বস্তি এলাকায়। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং মিরপুর বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর অপরাধীচক্রের ১৭২ জন সক্রিয় বলে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। তেজগাঁও ও উত্তরায়ও কিশোর গ্যাং তৎপর। র্যাবের পক্ষ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তারের একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে র্যাবের অভিযানে ৩৪৯ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব জানায়, ২০১৭ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত এক হাজার ১২৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এর ভেতর মোট ৪০ জনের মধ্যে ৩০ জনকে অর্থদ- ও ১০ জনকে মুচলেকা দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়াও গত বছরের ২২ মে রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার আগে ১০ মে দনিয়া কলেজের সামনে ‘জুনিয়র-সিনিয়র’ দ্বন্দ্বে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাজুন ইসলাম ওরফে মুশফিক। পুলিশ জানায়, দুটি হত্যাকা-ের পেছনে এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধী চক্র জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছর (২০২৩) ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় ২৫ জন। ২০২২ সালে ৩০ জন। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ২০২৩ সালে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের ৩৪৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এই তথ্য জানান। জানা গেছে, সাভার ও আশুলিয়ার পাড়ায় ও মহাল্লায় কিশোর গ্যাঙের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সন্ধ্যা হলেই এসব কিশোর দলবেঁধে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে সড়কে নেমে পড়ে। বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেল রেসে তারা লিপ্ত হচ্ছে। পথচারি নারীদের শাড়ি ওড়না ধরে তারা অহরহ টান দেয়। সুযোগ পেলে তারা ছিনতাইও করে। এছাড়া বিভিন্ন ফাঁকা স্থানে জমায়েত হয়ে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করছে। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, কিশোর গ্যাংয়ের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামে গ্রুপ। এরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ হয়ে। পান থেকে চুন খসলেই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে যেমন কাইচ্চাবাড়ি ও ভাই ব্রাদার গ্রুপ। দুই পক্ষের সংঘর্ষে লিখন নামের যুবক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে । অবশ্যই এঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতারের পর র্যাব বলছে, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তারা। এলাকায় দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকে গ্রুপগুলো। গত ০৪ জুলাই সন্ধ্যায় পূর্বশত্রুতার জেরে আশুলিয়া পলাশবাড়ি গোচারারটেক ইস্টার্ন হাউজিং মাঠের পাশে লোহার রড ও দেশীয় অস্ত্রসহ ‘গোচারটেক ভাই বেরাদার’ নামের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মেহেদীর উপর হামলা করে প্রতিপক্ষ ‘কাইচ্চাবারি’ নামের কিশোর গ্যাং গ্রুপের লিডার রনি ও তার লোকজন। এসময় বন্ধু মেহেদীকে মারধর করতে দেখে তাকে বাঁচাতে আসে লিখন। মেহেদীর সাথে এসময় লিখনকেও এলোপাতাড়ি মারধর করে রনি ও তার গ্যাং। একপর্যায়ে লোহার রোডের আঘাতে লিখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ও তার নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। হামলাকারীরা তখন দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গেলে স্থানীয়রা লিখনকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও মেহেদীকে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পরের দিন ৫ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় লিখনের মৃত্যু হয়। সেদিন ভুক্তভোগীর চাচা শরিফুল ইসলাম বাবু আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর সভার ও আশুলিয়ায় কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর দৌরাত্ব ও অপরাধ প্রবণতা নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
এতে পুলিশের বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব-৪ উক্ত চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনায় ছায়া তদন্ত শুরু করে ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। র্যাব-৪ এর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রাকিব মাহমুদ খান জানান, এই হত্যাকান্ডের পর আসামিরা দিনাজপুর, রংপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠি ও গাজীপুরে আত্মগোপনে ছিল। এসময় তারা কোন মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেনি। একপর্যায়ে তারা টাকা-পয়সা সংগ্রহের জন্য আশুলিয়ায় আসলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪ এর একটি টিম।আসামিরা সকলেই এই হত্যাকান্ডে জড়িত মর্মে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। এলাকা ঘুরে দেখাযায়,সাভারের নবীনগর তেলের পাম্প,সাভার বাসষ্টান্ড গলি,আশুলিয়ার জামগড়া,রেরন,নরসিংহপুর,ইয়ারপুর,দেওয়ান পাম্পগলি,অন্ধকলোনি গলি,পল্লীবিদ্যুত গলি এলাকায়ও কিশোর গ্যাঙের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। এ বিষয়ে সচেতনজনেরা বলেছেন কিশোর গ্যাং দমাতে না পারলে গোটা সমাজ ব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়বে। অনুসন্ধানে জানাযায়, সমাজব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রের নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসাবে কাজ করে। একই কমিউনিটির ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে, তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যকে বঞ্চিতদের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা অনুভব করে। আবার কমিউনিটিতে যখন অস্ত্র ও বিশেষ করে মাদকের দৌরাত্ম্য থাকে তখন গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে এবং বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে অথবা ওই গ্যাংয়ের বিদ্রোহী, দলছুট বা বহিষ্কৃত সদস্যরা আরেকটি গ্যাং তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ কমিউনিটিতে যখন গ্যাংয়ে যোগদান করার অভ্যাস অথবা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন একজন অপরকে বা সিনিয়রকে দেখে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। কখনো ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে অনুকরণপ্রবণশীল কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। তখন সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায় কিশোররা। তাই পরিবারের করণীয়টা এখানে বড় হয়ে দাঁড়ায়। পারিবারিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই এ সমস্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক/নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলেও কিশোররা এ পথে আসতে উৎসাহিত হয়। পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে অথবা পিতা-মাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মাঝে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্যাং তৈরির মধ্য দিয়ে সন্তান একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার চেষ্টা করে। একাধিক বিবাহ এবং পারিবারিক অশান্তিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থাও এ কালচার গড়ে ওঠার পেছনে কিছুটা দায়ী। যেমন- দুর্বল ছাত্রদের মধ্যে গ্যাং গড়ে তোলার প্রবণতা থাকে। ক্রমাগত শিক্ষকের বঞ্চনা, খারাপ ফলাফল, সহপাঠী দ্বারা বিদ্রূপের শিকার থেকে হতাশা তৈরি হতে পারে। হতাশা থেকে পরে গ্যাংয়ে যোগদানের প্রবণতা তৈরি হতে পারে। স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া কোনো কারণে ব্যাহত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জাগ্রত হতে পারে।ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদককে কেন্দ্র করে আড্ডা ইত্যাদি তৈরি হয়, যা থেকে গ্যাংয়ের উদ্ভব হতে পারে। বন্ধু-বান্ধবের যদি অপরাধপ্রবণতা থাকে বা তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে, মাদক সেবনের প্রবণতা থাকে বা মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এভাবে জড়িত হওয়ার কারণের মধ্যে আরও রয়েছে- ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা, দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিত্ব, হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা, অনুকরণপ্রবণতা, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি বা যৌন আসক্তি হওয়ার ক্ষেত্র ও সুযোগ তৈরি হওয়া। পুলিশ ও অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক অনুশাসনের অভাবে খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু-কিশোর। তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি, ফেসবুক-মোবাইল, প্রেম, চুরি-ছিনতাইসহ নানা ইস্যুতে সামান্য মতানৈক্য হলেই এদের মাথায় খুনের নেশা আসে। আবার মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজেদের স্বার্থে কিশোরদের অপরাধ জগতে টানছে। ফলে এই কিশোররা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা শুধু পাড়া-পড়শি নয়, নিজের পরিবারের জন্যও মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে ওঠছে।এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার মিল পাচ্ছে না অনেকে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোর বয়সে হিরোইজম ভাব থাকে। এই হিরোইজমকে সঠিক পথের অনুসারী করে তুলতে হবে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে ওঠছে। এর দায় আমাদের সবার। সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি বা যাদের কথা শুনবে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এই গ্যাং কালচার থেকে বিপদগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
আওরঙ্গজেব কামাল
লেখক, গবেষক