শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ অপরাহ্ন
মো. জামাল হোসেন, খুলনা প্রতিনিধি, কালের খবর : সাংবাদিকতার উর্বর ভূমি খুলনা। মানিক সাহা, হুমায়ূন কবির বালু, বেলাল উদ্দিন— এক ঝাঁক বিখ্যাত নাম। যাদের কলমের স্পর্শে গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক খুলনা। রাজনীতিক থেকে শুরু করে চরমপন্থীদের সব রক্ষচক্ষুকে উপেক্ষা করে পেশার মানকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়।
কিন্তু, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মানিক সাহা, বালুর মতো জেলার অর্ধডজন সাংবাদিকের প্রাণ গেছে ঘাতকের বুলেটে। প্রথম প্রথম ঘাতকদের বিচার চেয়ে রাস্তায় লড়েছেন, এক পর্যায়ে না পেয়ে হতাশ হয়েছেন। তারপরও আশা ছাড়েননি। স্বজন, প্রিয়জন ও সহকর্মী হারানোর বেদনা বুকে নিয়েই জেলার সাংবাদিকেরা কলম যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় তাদের পরিবার ও সহকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এ কারণে নিহতদের স্বজনেরা দুনিয়ার আদালতে বিচার না পেয়ে সৃষ্টিকর্তার আদালতে বিচার দিয়েছেন।
এমনকি রাজপথে নেমে কলম ভেঙে প্রতিবাদ জানিয়ে সাংবাদিকরা ‘বিচার পাই না, তাই বিচার চাই না’— এমন স্লোগান দিতেও বাধ্য হয়েছেন।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি গা-সয়া হওয়ায় এখন আর সাংবাদিক হত্যার বিচার নিয়ে খুব একটা আন্দোলন-সংগ্রাম বা রাজপথে নামেন না কেউই।
বর্তমানে খুলনা অঞ্চলে সাংবাদিক হত্যার ধারাবাহিকতা কিছুটা মন্থর হলেও ভয়ভীতি আর হুমকি-ধামকি অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে পেশাগত ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের।
গত দেড়যুগে পেশাগত কারণে খুলনায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হয়েছেন ৭ সাংবাদিক। এ সময়ে হামলার শিকারও হয়েছেন অনেকেই। একের পর এক সাংবাদিকের লাশ পড়লেও এ পর্যন্ত সঠিক বিচার হয়নি কোনো হত্যাকাণ্ডেরই।
রফিকুল ইসলাম রফিক
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ১৩ মার্চ রাত ১০টার দিকে নগরীর বিএল কলেজ ক্যাম্পাসে যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক লোকসমাজ’ পত্রিকার বিএল কলেজ প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম রফিককে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে। এ ঘটনায় মামলা হলেও খুনিরা এখন পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আসতে হয়নি।
নহর আলী
২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে জেলার ডুমুরিয়ার পল্লীতে খুলনা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক অণির্বাণ’ পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি নহর আলীকে ধরে নিয়ে নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বেধড়ক মারধর করে। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও পার্টির প্রধান মনোরঞ্জন গোসাই ওরফে মৃণালের হুমকিতে সাক্ষীরা আদালতে আসতে সাহস পাননি।
ভূমিহীন পরিবারের সদস্য নহর আলী ছিলেন সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক। তাকে হত্যায় দায়ের করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উত্থাপন করতে না পারায় ২০০৪ সালে ঘোষিত রায়ে সব আসামি খালাস পান।
২০০২ সালের ২ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয় ‘দৈনিক পূর্বাঞ্চল’র ক্রাইম রিপোর্টার হারুন-অর রশিদ খোকনকে
হারুন-অর রশিদ খোকন
২০০২ সালের ২ মার্চ মহানগরীর মুজগুন্নী এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন খুলনা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক পূর্বাঞ্চল’ পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার হারুন-অর রশিদ খোকন। এ খুনের ঘটনায় নিহতের শ্যালক মিস্টার মোড়ল বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে দৌলতপুর থানায় হত্যা মামলা করেন।
তদন্ত শেষে পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। দীর্ঘ বিচার শেষে অভিযুক্ত পাঁচ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
শুকুর আলী
২০০৩ সালের ৯ জুলাই ডুমুরিয়ায় আবারো ‘দৈনিক অনির্বাণ’ পত্রিকার উপজেলার প্রতিনিধি শুকুর আলীকে চরমপন্থীরা তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও তার সন্ধান মেলেনি। তবে, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ২০০৪ সালে ঘোষিত রায়ে সব আসামি খালাস পান।
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বোমা মেরে দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো প্রধান মানিক চন্দ্র সাহাকে হত্যা করা হয়
মানিক চন্দ্র সাহা
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের অদূরে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো প্রধান মানিক চন্দ্র সাহা। তিনি ওই সময় খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও বিবিসি বাংলা বিভাগের কন্ট্রিবিউটর ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর ১৭ জানুয়ারি অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন খুলনা সদর থানার এসআই রনজিৎ কুমার দাস।
হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা সদর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন ২০০৪ সালের ২০ জুন চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী সংগঠনের তিন নেতাসহ মোট ১৩ জনকে আসামি করা হয়।
এর আগে ২০০৪ সালের ১৯ মার্চ বিস্ফোরক মামলায় একই আসামিদের অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আসাদুজ্জামান ফরাজী। পরে ২০০৭ সালের ২ ডিসেম্বর হত্যা মামলার অধিকতর তদন্তের চার্জশিটে কচি ওরফে হাই ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মামলার বিচার শুরুর আগেই আবদুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপন, বিডিআর আলতাফ এবং মাহফুজ ওরফে মফিজ মারা গেলে মামলার কার্যক্রম থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়। হত্যা মামলায় ১১ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ১০ জনের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মানিক চন্দ্র সাহা হত্যা মামলায় ৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।
একইসঙ্গে প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার অপর দুই আসামিকে খালাস দেয়া হয়।
একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা পৃথক আরেকটি মামলায় ১০ আসামির সবাইকে খালাস দেন আদালত।
খুলনা বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম এ রব হাওলাদার এই রায় ঘোষণা করেন।
বিস্ফোরক মামলার সব আসামি খালাস পাওয়া প্রসঙ্গে আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, ‘মামলার চার্জশিট প্রদানকারী তদন্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ফরাজী মারা যাওয়ায় চার্জশিটের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। এছাড়া বিস্ফোরক মামলার ১৩ জন সাক্ষীর কেউই আসামিদের নাম বলতে পারেননি। হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী যিনি জবানবন্দি প্রদান করেছেন, তাকেই বিস্ফোরক মামলায় সাক্ষী করা হয়নি। এসব কারণে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন।’
পরে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। দীর্ঘ সময়েও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হওয়ায় ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন নিহত সাংবাদিক মানিক সাহার স্ত্রী নন্দা সাহা, মেয়ে নাতাশা সাহা ও পর্শিয়া সাহা। সেই সঙ্গে ন্যায়বিচারের আশা করছেন না খুলনার স্থানীয় সাংবাদিকরাও।
২০০৪ সালের ২৭ জুন ‘দৈনিক জন্মভূমি’ সম্পাদক হুমায়ূন কবির বালু বোমা হামলায় নিহত হন
হুমায়ূন কবির বালু
২০০৪ সালের ২৭ জুন খুলনা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক জন্মভূমি’ পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ূন কবির বালু বোমা হামলায় নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের পরদিন খুলনা থানার এসআই মারুফ বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক ধারায় দুটি মামলা দায়ের করেন।
একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বদল শেষে হত্যা মামলায় ১১ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়। এ ঘটনায় দায়ের মামলাটির একটি অংশ হত্যা মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুস সালাম সিকদার ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সবাইকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।
বিচারক তার রায়ে বলেন, ‘কোনো সাক্ষীই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেননি। অনেক সাক্ষী সাক্ষ্য দেননি। আদালত থেকে সমন জারি করেও সাক্ষীদের আনা যায়নি। উপরন্তু তদন্তে যেসব বিষয় গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল এবং যাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা সাক্ষী করা প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি। এ মামলার সব দিক পর্যালোচনা করে আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সারকামসটেনশিয়াল এভিডেন্স পাইনি, যাতে অকাট্যভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়।’
হত্যা মামলায় কেউই অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত এবং সাজা না পাওয়ায় বালুর স্বজন ও সহকর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হন। মামলাটি আবারো তদন্তের দাবি ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এনামুল হক হত্যা মামলার দুর্বল দিকগুলো উল্লেখ করে বিস্ফোরক মামলাটি আরো তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন জানান। আদালত আবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আদেশ দেন।
বিস্ফোরক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যশোর অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাইয়ুম শিকদার দায়িত্ব নেয়ার পর দাবি করেছিলেন, প্রতিবেদনের যেসব দুর্বলতার কারণে আসামি খালাস পায়, সেসব বিষয় বিবেচনায় এনে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। কিন্তু, যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, তাতে হত্যার পরিকল্পনাকারী ও আর্থিক জোগানদাতাসহ বস্তুগত কোনো সাক্ষ্য বর্ণিত হয়নি।
২০০৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবে রিমোর্ট কেন্ট্রাল বোমায় আহত হন, পরে হাসপাতালে মারা যান শেখ বেলাল উদ্দিন
শেখ বেলাল উদ্দিন
২০০৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ৯টার দিকে খুলনা প্রেসক্লাবের অভ্যর্থনা কক্ষের সামনে মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেলে সন্ত্রাসীদের রাখা রিমোট কন্ট্রোল বোমায় খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন খুলনার সাবেক সভাপতি ও দৈনিক সংগ্রামের ব্যুরো প্রধান শেখ বেলাল উদ্দিন গুরুতর আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পরদিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান।
নিহত সাংবাদিক বেলাল উদ্দিনের বাড়ি স্বজনদের কাছে কেবলই স্মৃতি
এর আগে ঘটনা রাতে খুলনা সদর থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে আহত ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। নিহত হওয়ার পর দায়ের করা মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। এই মামলায় ২০০৭ সালের ২৯ নভেম্বর খুলনার বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে চরমপন্থী নেতা হাসান, স্বাধীন ও মেরাজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন। বিস্ফোরক অংশেও একই রায় হয়।
২০০৫ সালের ২৫ এপ্রিল খুলনা সদর থানার ওসি ইকবাল হোসেন চরমপন্থী নেতা হাসান, স্বাধীন, মেরাজ ও রিকশাচালক গদা ইউনুসকে আসামি করে আদালতে বিস্ফোরক অংশের চার্জশিট দাখিল করেন। এ সময় সাংবাদিকরা এই চার্জশিট প্রত্যাখান করেন।
অন্যদিকে, দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাহাবুদ্দিন লস্কর ধীরা ও এখলাসুর রহমান এখলাস, চরমপন্থী নেতা রফিকুল ইসলাম ওরফে হাসান, ইকবাল হোসেন স্বাধীন ও মেরাজুল ইসলাম মেরাজ এবং রিকশাচালক গদা ইউনুসকে অভিযুক্ত করে একই বছর ১৭ নভেম্বর হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
পরে ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ওসি আব্দুল হামিদ রিকশাচালক গদা ইউনুসকে বাদ দিয়ে বাকি ৫ জনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অংশের সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। পরবর্তীতে সিএমএম আদালত থেকে মামলাটি খুলনার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ তৃতীয় আদালতে প্রেরণ করা হয়। ২০০৬ সালের ২৯ জুন আদালতের বিচারক মশিউর রহমান উপরোক্ত ৬ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন। এরপর হত্যা মামলাটি ২০০৭ সালের ১৭ জুন খুলনা বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা হয়। এখানে ১১১ কার্যদিবস শেষে ২০০৭ সালের ২৯ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুস সালাম শিকদার হত্যা মামলায় আসামি চরমপন্থী নেতা হাসান, স্বাধীন ও মেরাজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
এদিকে, বিস্ফোরক অংশের মামলাটি একই বছরের ১০ জুলাই দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা হয়। এখানে মাত্র ৯৫ কার্যদিবসে আসামিদের বিরুদ্ধে একই সাজা দেয়া হয়। দু’জন সাফাই সাক্ষীসহ ৩১ জন সাক্ষ্য দেন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন পিপি এসএম আবু জাদা। আসামি পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোস্তফা ইউনুস। দুটি মামলার রায়ে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত চরমপন্থী নেতা হাসান, স্বাধীন ও মেরাজ কারাভোগ করছেন।
দীপ আজাদ
২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীতে সাংবাদিক দীপ আজাদের ওপর বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তৎকালীন জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোফাজ্জেল হোসেন ও চরমপন্থী নেতা স্বাধীন, হাসান, মেরাজুল, টল বাবু ও এখলাসুর রহমানকে গ্রেফতার করে র্যা ব।
এদের মধ্যে চরমপন্থী নেতা হাসান, স্বাধীন ও মেরাজুল ইসলামকে সাংবাদিক বেলাল উদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর রিকশাচালক গদা ইউনুস, চরমপন্থী নেতা স্বাধীন ও এখলাসুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। মামলার তদন্তকালে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
এ অঞ্চলের সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে খুলনার সাংবাদিক হুমায়ূন কবির বালু ও হারুণ-অর রশিদ হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিদের সবাই।
শেখ বেলাল উদ্দিন হত্যা মামলার রায় হলেও এ নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন তার পরিবার ও সাংবাদিকরা।
এছাড়া সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যা মামলার রায়েও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা ও অর্থ যোগানদাতাদের নাম আসেনি বলে অভিযোগ রয়েছে পরিবার ও সাংবাদিকদের।
এভাবে বেশিরভাগ সাংবাদিক হত্যা মামলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার কারণে। স্বাভাবিক কারণে সর্বশেষ সাংবাদিক হত্যার ঘটনার পর সাংবাদিক সমাজ রাজপথে নামলেও তাদের মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের হতাশা।
ভাই বেলাল উদ্দীন হত্যার বিচার নিয়ে কালের খবরকে আক্ষেপের কথা বলছেন শেখ শামসুদ্দিন দোহা।
এ বিষয়ে চরম ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করে নিহত সাংবাদিক শেখ বেলাল উদ্দীনের ছোট ভাই শেখ শামসুদ্দিন দোহা কালের খবরকে বলেন, ‘আমার ভাই হত্যা মামলায় কয়েকজনকে নামমাত্র সাজা দেয়া হয়। কিন্তু, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা ও অর্থ যোগানদাতাদের নাম আসেনি। ফলে আমরা ভাই হত্যার প্রকৃত বিচার পাইনি। এ কারণে আল্লাহর আদালতে বিচারের অপেক্ষায় আছি।’
স্বামী হত্যার বিচার আল্লাহর কাছে দিয়েছেন হারুণ-অর রশীদ খোকনের স্ত্রী মিনারা বেগম
খুন হওয়া অপর সাংবাদিক হারুণ-অর রশীদ খোকনের স্ত্রী মিনারা বেগম মিনুও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
তিনি হতাশা ও ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘যারা তার স্বামীকে ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে খুন করিয়েছে, সমাজের সেইসব মুখোশ পরা প্রভাবশালী লোকজন এখনো মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। তাদের দেখলে খুবই কষ্ট হয়। কিন্তু, পুলিশ টাকার বিনিময়ে চার্জশিটে না আনায় তাদের শাস্তি হয়নি।’
মিনারা বেগম আরো বলেন, ২ মেয়ে ও ১ ছেলেকে শিশু অবস্থায় থাকাকালে তার স্বামীকে খুন করা হয়।
রশীদ খোকনসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার চেয়ে জাতীয় কনভেনশন
এতিম তিন সন্তানকে নিয়ে মিনারা বেগম ১৭ বছর ধরে হতাশার সাগরে ভাসছেন। তবে, সাংবাদিক ও বর্তমান সরকারের সহায়তা পেয়েছেন। বর্তমানে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিনি অসুস্থ। মিনারাও এখন এই বিচার আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করেন।
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন
এ বিষয়ে মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন, খুলনার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফোরামের সদস্য মুহাম্মদ নূরুজ্জামান কালের খবরকে বলেন, ‘খুলনায় কেন জানি সাংবাদিক হত্যার ক্ষেত্রে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রচলন চলছে। এখন হত্যা কম হলেও পেশাগত ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ হলে মাদক ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও চোরাকারবারীরা ক্ষুব্ধ হন। রাজনৈতিক দলের নেতারাও নেতিবাচক রিপোর্ট মানতে চান না।’
এছাড়া পুলিশ বিভাগ ও অন্যান্য প্রশাসনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। ফলে ঘরে-বাইরে সবখানে সারাক্ষণই সাংবাদিকদের ঝুঁকির মুখে কাজ করতে হয়। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের সার্বিক নিরাপত্তার দাবি জানান।
এহতেশামুল হক শাওন, মহাসচিব, খুলনা প্রেসক্লাব
প্রেসক্লাব খুলনার মহাসচিব ও বন্ধ আমার দেশ পত্রিকার ব্যুরো প্রধান এহতেশামুল হক শাওন কালের খবরকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতেই বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়।’
তিনি নিহত সাংবাদিকদের হত্যাকারীদের শাস্তি এবং ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কেএম জিয়াউস সাদাত, ট্রেজারার, খুলনা প্রেসক্লাব
প্রেসক্লাব খুলনার ট্রেজারার কেএম জিয়াউস সাদাত কালের খবরকে বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতা নজিরবিহীন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সম্প্রতি পাবনায় নিজ বাসার সামনে প্রকাশ্যে একজন নারী সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিগত দিনে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়ার কারণেই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।’
কথিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ফাঁদে ফেলেও সাংবাদিকদের শায়েস্তা করা হচ্ছে। এতে করে স্বাধীন সাংবাদিকতা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।