মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২০ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের খবর : সারা দেশে মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির ভিত্তিতে এ অভিযান চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। অভিযানে গত ছয় দিনেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্তত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। র্যাব ও পুলিশের দাবি নিহতরা মাদক ব্যবসা ও পাচারের সঙ্গে জড়িত। অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তাদের মৃত্যু হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা দেশে এ অভিযান পরিচালনা করছে। এটি সামনেও চলবে। অভিযানে মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত সহস্রাধিক ব্যক্তি গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছেন অভিযানকারীরা। এদিকে বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে গত ১৬ দিনে মাদকবিরোধী অভিযানে ১৮ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মাদকবিরোধী অভিযানে গত শনিবার রাত থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৪ জন। ময়মনসিংহ, ফেনী, দিনাজপুর ও যশোরে এসব ঘটনা ঘটে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। এর আগের পাঁচদিনে এ ধরনের ঘটনায় মারা যান আরো নয়জন।
শনিবার রাত সোয়া ২টার দিকে ময়মনসিংহের মাসকান্দা এলাকার গনশার মোড়ে গোয়েন্দা পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৪০ বছর বয়সী রিয়াজুল ইসলাম বিপ্লব। রোববার ভোরের দিকে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের পশ্চিম পাঠান গড় এলাকায় থানা পুলিশের গুলিতে নিহত হন পাঠান গড় গ্রামের আবদুস ছালামের ছেলে আলমগীর হোসেন ভূইয়া (৩৩)। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ঘটনাটি ঘটে রাত সাড়ে ৩টার দিকে। সেখানে পুলিশের গুলিতে নিহত বাবু ওরফে গালকাটা বাবু (৪৫) বিরলের তেঘরা নারায়ণপুর গ্রামের ওহাব আলীর ছেলে। আর যশোরে ‘মাদক চোরাকারবারিদের দুই দলের মধ্যে’ গোলাগুলির খবর পেয়ে ছুটিপুর সড়কের রুদ্রপুর গ্রামে গিয়ে ভোরের দিকে অজ্ঞাতপরিচয় আরেক ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের খবর জানিয়েছে পুলিশ।
ময়মনসিংহ: জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান জানান, রমজান মাসে মাদক ছড়িয়ে দিতে কতিপয় মাদক বিক্রেতা মাদক ভাগাভাগি করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে নগরীর মাসকান্দা গনশার মোড় এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুড়ে। পরে অন্যান্য মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেলেও গুলিবিদ্ধ হয় মাদক সম্রাট বিপ্লব। পরে তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বিপ্লবকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল তল্লাশি করে ২শ’ গ্রাম হিরোইন, ২শ’ পিস ইয়াবা, তিনটি গুলির খোসা ও দুটি চাকু উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল রাশেদুল ও কাওছার আহত হন বলেও জানান ওসি।
যশোর: কোতোয়ালি থানার অফিসার ইন চার্জ আজমল হুদা জানান, শনিবার রাত ৩টার দিকে খবর আসে আরবপুর এলাকার আকবার মিয়ার রড ফ্যাক্টরির এলাকায় দু’দল মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। খবর পাওয়ার পর পরই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং পুলিশের উপস্থিতি টেরে পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে অজ্ঞাত (৩৫) এক যুবককে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে দ্রুত যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, ৫০০ পিস ইয়াবা, ২ রাউন্ড গুলি ও ৪ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করে। এই ঘটনার আগের রাতে যশোরের অভয়নগরের বাগদহ গ্রামে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয় ৩ জন।
ফেনী: ছাগলনাইয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এম মোর্শেদ জানান, শনিবার মধ্যরাতে ছাগলনাইয়ার পশ্চিম পাঠান গড় এলাকায় মাদকের একটি বড় চালান যাচ্ছিল এ সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশের একটি দল অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি ছোড়ে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে উপজেলার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও একাধিক মামলার আলমগীর হোসেন ভূঞা গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। পরে আহত আলমগীরকে উদ্ধার করে ফেনী জেলা সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এ ঘটনায় দেলোয়ার হোসেন ও মতিয়ার রহমান নামে পুলিশের দুই সহকারী উপ-পরিদর্শক আহত হয়। আহত পুলিশ সদস্যরা জেলা সদর হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। পুলিশ আরো জানায়, ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি বন্দুক, তিন রাউন্ড গুলি, এক হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও শতাধিক বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে।
দিনাজপুর: দিনাজপুরের বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ সরকার জানান, ফেনসিডিলের চালান যাচ্ছে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিরল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী গাল কাটা বাবু ও তার সহযোগিতা পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী গাল কাটা বাবু (৪০) নিহত হয়। এ সময় আহত হয়েছে, পুলিশের দুই কনস্টেবল আরিফুল ও শহিদুল ইসলাম। তাদের দিনাজপুর এম.আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহত বাবু’র লাশ সুরত হাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর এম.আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।
মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এর আগেও নিহত হয়েছেন ৯ জন। শুক্রবার রাতে যশোরে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছে তিন মাদক ব্যবসায়ী। নিহতরা হলেন- উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের কাদের আলী মোড়লের ছেলে আবুল কালাম (৪৭), একই গ্রামের আবদুল বারিক শেখের ছেলে হাবিবুর রহমান (৩৮) ও আবদুস সাত্তার কাঁসারির ছেলে মিলন কাঁসারি (৪০)। এর আগে চট্টগ্রামে দুই মাদক ব্যবসায়ী র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। নগরীর বরিশাল কলোনিতে ওই দুই ব্যবসায়ীর অবস্থানের কথা জানতে পেরে র্যাবের একটি দল টহল দিতে থাকে। এরপর র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছোড়ে তারা। এ সময় র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই দুই মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে র্যাবের বন্দুকযুদ্ধে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে র্যাব ৬ কেজি ৭শ গ্রাম গাঁজা, ২টি পিস্তল, ৭ রাউন্ড গুলি ও ২টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করে। গত ১৭ই মে রাজশাহীর নবগঙ্গা এলাকায় অভিযান চালানোর সময় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নগরীর হাসান নামের এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। র?্যাবের ভাষ্যমতে, হাসান দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওই রাত সাড়ে ১২টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজশাহী নগরীর পশ্চিম নবগঙ্গা কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় অভিযান চালায় র?্যাব। এ সময় কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী সেখানে মাদক কেনাবেচার জন্য জড়ো হয়েছিল। তারা র?্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছুড়তে থাকে। র?্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। বন্দুকযুদ্ধের একপর্যায়ে মাদক ব্যবসায়ী হাসান নিহত হন। এ সময় পালিয়ে যায় অন্যরা। এর আগে বন্দুকযুদ্ধে কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জে আরো দুই জনের মৃত্যু হয়।
ডিএমপির অভিযানে আরো ৯২ মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারী গ্রেপ্তার: এদিকে শনিবার সকাল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যরা ৯২ জন মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব অভিযান পরিচালিত হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে আরো ১ লাখ ১৩ হাজার ৮২৭টি ইয়াবা ট্যাবলেট, ১ কেজি ৯৯ গ্রাম ওজনের ১ হাজার ১৮৩ পুরিয়া হেরোইন, ৫৩ কেজি ৮৬৫ গ্রাম গাঁজা, ৮১ বোতল ফেনসিডিল ও ২০টি ইনজেকশন উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা ৫৮টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
…দৈনিক কালের খবর