বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৬ অপরাহ্ন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নিয়োগ শর্ত লঙ্ঘন করে শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে আইন বিভাগের বিভাগের বর্তমান সহকারী অধ্যাপক নূর নুসরাত সুলতানার বিরুদ্ধে। বিভাগের সাবেক ছাত্র ও বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. নূরুল হুদা হাইকোর্টে তার বিরুদ্ধে একটি রিট করেন। এতে নূর নুসরাতসহ আইন বিভাগের তিনজন শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ বলে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনের ২১ নম্বর পর্যবেক্ষণে নূর নুসরাতের নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে ইউজিসির তদন্ত কমিটি। এরপর প্রায় ৪ বছর হয়ে পেরিয়ে গেলেও অদৃশ্য কারণে এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
অভিযুক্ত শিক্ষক নূর নুসরাত সুলতানা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজশাহী ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর মেয়ে। ২০১৮ সালে বাবার তদবিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের সময়ে নিয়োগ পান তিনি। অন্য দুজন শিক্ষক হলেন আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সালাউদ্দিন সাইমুম ও বনশ্রী রাণী। এর মধ্যে বনশ্রী রাণী এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
২০১৮ সালের আইন বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর যেকোনো একটিতে (সনাতনী পদ্ধতিতে) প্রথম শ্রেণি এবং গ্রেডিং পদ্ধতিতে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫০ থাকতে হবে। কিন্তু নূর নুসরাতের একটিতেও প্রথম শ্রেণি বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫০ নেই বলে ইউজিসির তদন্তে বেরিয়ে আসে। তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। তবুও ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান নূর নুসরাত।
নূর নুসরাত সুলতানার আবেদনপত্র থেকে জানা যায়, তিনি ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে বিপিপি বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডন থেকে ৬৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতকোত্তরে ৬৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ নম্বর (মার্কস) প্রথম শ্রেণি হিসেবে নিয়োগ বোর্ডে উল্লেখ করেন নূর নুসরাত। কিন্তু বিপিপি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রেডিং পলিসি অনুযায়ী ৬৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ নম্বর দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া ইউজিসি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গ্রেডিং পলিসি অনুযায়ী ৬৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ নম্বরকে সিজিপিএ-৩ বা দ্বিতীয় শ্রেণি ধরা হয়।
এছাড়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আরেকটি শর্ত ছিল, অনলাইন বা দূরশীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ডিগ্রি আবেদনের অযোগ্যতা বলে গণ্য হবে। কিন্তু নূর নুসরাত সুলতানার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রাপ্ত ডিগ্রিটি অনলাইন বা দূরশীক্ষণের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে বলে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। নূর নুসরাত সুলতানা ২০০৫ সালে এইচএসসি পাশের ৮ বছর পর স্নাতক এবং ৩ বছর পর স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদন থেকে আরো জানা গেছে, ২০১৮ সালের আইন বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারীদের যোগ্যতার তথ্য অনুযায়ী, নূর নুসারতের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটি হল বিদেশি। ফলে বিদেশি ডিগ্রি সমতায়ন না করেই স্নাতকত্তোর প্রাপ্ত ৬৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ নম্বরকে প্রথম শ্রেণি দেখিয়ে নিয়োগদান সম্পূর্ণ অবৈধ বলে মনে করে ইউজিসি তদন্ত কমিটি।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নূর নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘বিদেশি ডিগ্রির ৬০ শতাংশ নম্বরে প্রথম শ্রেণি দেখিয়ে অনেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। একই সমান নম্বর দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে শাহরিয়ার স্যার নিয়োগ পান, পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও যোগ দেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তারেক নূর স্যারও এভাবেই নিয়োগ পান।’
নূর নুসরাত বলেন, ‘নর্থ আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান মাস্টার্সকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিনেন্সে এমফিল-এর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। বিদেশি ডিগ্রির গ্রেডিংয়ের ওপর বিভিন্ন ক্যাটাগরি রয়েছে। ৬০ শতাংশ নম্বরকে দেশে প্রথম শ্রেণি ধরা হয়।’ এভাবেই প্রথম শ্রেণি ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
রিটের বিষয়ে জানতে চাইলে রাবির সাবেক ছাত্র ও আইনজীবী নূরুল হুদা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি হলে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা আদালত বাতিল করতে পারেন। ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের আইন বিভাগে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ইউজিসি তদন্ত কমিটি অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রায় ৪ বছর হয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো নূর নুসরাত সুলতানাসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যেটা খুবই হতাশাজনক।’
আইনজীবী নূরুল হুদা বলেন, ‘২০২০ সালের ডিসেম্বরে ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে কোনো প্রতিকার না পেয়ে আমি আইন বিভাগের ওই নিয়োগ বাতিলের জন্য রিট করি। আমার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই নিয়োগ বাতিলের রুল জারি করেছে। এ বছরের শেষে ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানী হতে পারে বলে জানান তিনি।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘নম্বর জালিয়াতি করে আইন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নূর নুসরাতের নিয়োগের বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা ছিল না।’ এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।