এম আই ফারুক /পার্থ সারথি দাস , কালের খবর : দিনভর কাঠফাটা রোদ। মাইক্রোবাস থেকে নামলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম।
চোখে চশমা, পরনে কালো প্যান্ট, স্টাইপ করা শার্ট। থুতনিতে একটু দাড়ি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লেখা বিআরটিএর গাড়ি দেখলে দালালরা পালাবে। তাই গাড়ি একটু দূরে রেখে মূল সড়ক ধরে হেঁটে পাশের একটি বটগাছের নিচে দাঁড়ালেন। দূর থেকে তাঁকে অনুসরণ করছিল পুলিশ, আনসার দল। মাজহারুল ইসলাম বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে সামান্য অপেক্ষার পরই তাঁর কাছে হাজির হয় তিন যুবক। ঝটপট বলে, ‘কী করতে হবে স্যার? ড্রাইভিং লাইসেন্স না ফিটনেস?’ মাজহারুল একটু থেমে লাইসেন্সের জন্য অতিরিক্ত কত টাকা দিতে হবে জানতে চাইলেন। অন্যান্য খাতে কত টাকা বেশি দিলে কাজ হবে তাও জানতে চাইলেন। তিন যুবক অনেকটা প্রতিযোগিতা করেই সব জানাল।
মাজহারুলের আর বুঝতে বাকি থাকে না এই যুবকরা দালাল। এরপর তিনি হাত ইশারা করতেই ছুটে এসে অনুসরণকারীরা আটক করে ওই তিন দালালকে। সেবাগ্রহীতা সেজে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম গতকাল বুধবার কৌশলে বটগাছের নিচ ছাড়াও বিআরটিএ মিরপুরের ব্যাংকের কাউন্টারের সামনে ও মূল ফটকের পাশ থেকে ১৪ দালালকে আটক করেন।
অভিযানে অংশ নেওয়া আনসারের প্লাটুন কমান্ডার মনির হোসেন জানান, গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিট থেকে সকাল ১১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বটগাছের নিচ, বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের প্রথম গেটের আশপাশ ও ব্যাংকের সামনে থেকে মোট ১৪ জন দালালকে আটক করা হয়। তাদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জনকে দুই মাস করে কারাদণ্ড, একজনকে দুই মাসের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা, আরেকজনকে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আটকের পর এই দালালদের প্রথমে কাফরুল থানায়, সেখান থেকে পরে কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অভিযানে অংশ নেওয়া বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম কালের খবরকে বলেন, ‘ওরা সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছিল। মিরপুর বিআরটিএতে বিভিন্ন কাজের চাপ বেড়েছে। এই সুযোগে কাজ বাগিয়ে নিতে সেখানে দালালদের উৎপাত বেড়ে গেছে। ’
অন্যদিকে গতকাল সকাল ৯টায় বিআরটিএর ওই কার্যালয়ে হঠাৎ হাজির হয়ে সেবাদান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এহছানে এলাহীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল। এই দলে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন উপসচিব নজরুল ইসলাম সরকার ও বিআরটিএ সদর কার্যালয়ের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নুর মোহাম্মদ মজুমদার।
মিরপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক (প্রকৌশল) মাসুদ আলমের কক্ষে বসে সিসিটিভিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন নুর মোহাম্মদ মজুমদার। যুগ্ম সচিব এহছানে এলাহী মাইক্রোফোনে সেবাগ্রহীতাদের লক্ষ্য করে বলতে থাকেন, ‘কোনো অভিযোগ থাকলে আপনারা অভিযোগ করুন। ’
বিআরটিএর ওই কার্যালয় প্রাঙ্গণে ২০টি কাউন্টার। শিক্ষানবিশ লাইসেন্স নেওয়ার জন্য ভিড় উপচে পড়ছিল। একই ধরনের ভিড় লক্ষ করা গেছে মোটরযান পরিদর্শন কেন্দ্রেও। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও সেবা পাননি সাবের আহমদ। এভাবে অনেকেই ধৈর্য হারাচ্ছিলেন। সেবাদান ছিল খুবই ধীরগতির।
এ অবস্থায় অভিযোগ জানাতে মাসুদ আলমের কক্ষে ছুটে আসেন অনেক সেবাগ্রহীতারা। পরে বিকল্প জনবল দিয়ে ধীরগতির সেবায় গতি ফেরানো হয়।
গাড়ি নিয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা গাড়িচালক মো. হাসান জানান, মানুষের চাপ বেশি। ফলে তিনি দালাল ধরে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এখন আর দালালকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, ওই কার্যালয়ের পাশের গলিতে দালালদের বসে থাকার নির্দিষ্ট দোকানঘরগুলোও বন্ধ। শিক্ষানবিশ লাইসেন্স করার জন্য আইনজীবী, সরকারি চাকুরে, পুলিশ কর্মকর্তারা আবেদনপত্র নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদের জন্য চিকিৎসকের সিল ও স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে দালাল খুঁজছিলেন। পরে তাঁরা টোটাল সলিউশন নামের একটি দোকানে রমজান আলী নামের এক দালালকে খুঁজে পান। রমজান তাঁদের জানায়, চিকিৎসকের সিল ও স্বাক্ষর এনে দিলে আগে ১৫০ টাকা লাগত, এখন নিচ্ছে ২০০ টাকা। এর সঙ্গে তার জন্য আরো ৫০ টাকা। অর্থাৎ একেকটি আবেদনপত্রের সঙ্গে নগদ ২৫০ টাকা নিচ্ছিল রমজান। সেবাগ্রহীতা হিসেবে রমজানের সঙ্গে আলাপকালে সে জানায়, মঙ্গলবার রাতে সড়কমন্ত্রী এসেছিলেন। আজ (গতকাল) মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ভেতরে আছেন। ফলে ভেতরে দালালরা প্রবেশ করতে পারছে না। অন্যদিকে অভিযানের কারণে দুপুরেই দালালরা সেখান থেকে কেটে পড়ে।
গতকাল দুপুরে উপপরিচালক মাসুদ আলমের কক্ষে বসে সিসিটিভিতে পুরো কার্যালয়ের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করছিলেন যুগ্ম সচিব এহছানে এলাহীসহ আকস্মিক পরিদর্শনে হাজির হওয়া প্রতিনিধিরা। এহছানে এলাহী কালের খবরকে বলেন, ‘লম্বা লাইন সামনে এগোচ্ছিল না। বিভিন্ন কাউন্টারে একই কর্মকর্তা ক্লান্ত হয়ে হয়তো অন্যত্র গেছেন, কেউ কেউ টানা সেবা দিতে অনীহ ছিলেন, ওই সব কাউন্টারে বিকল্প জনবল দিয়ে আমরা সমস্যার সমাধান করেছি। কাজ গতিহীন ছিল। আমরা চেয়েছি কোনো কাউন্টারে যেন সেবা বন্ধ না থাকে। গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত সেবা দেওয়া হয়েছে। ’ তাঁর সঙ্গে আলাপকালে ধানমণ্ডি থেকে সকালে আসা জসীম উদ্দিন লাইসেন্সের ধরন হালকা থেকে অন্য শ্রেণিতে পরিবর্তনে কী করা উচিত জানতে চাইলে মাসুদ আলমের সহকারীরা বিষয়টি তাঁকে বুঝিয়ে দেন।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তদারকি করার সময় দুপুরে উপস্থিত হন বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান। সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে বিভিন্ন সেবার কাউন্টারের সামনে গিয়ে সেবা দিতে বিলম্ব হচ্ছে কি না তার খোঁজখবর নেন। পরে তিনি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।
গাড়ি নিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস, মালিকানা বদলিসহ বিভিন্ন কাজে বিআরটিএ কর্মকর্তারা জড়িত। দালালদের মাধ্যমে তাঁদের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উপপরিচালক মাসুদ আলম কালের খবরকে বলেন, ‘যারা দুর্নীতি করে তাদের বদলিসহ অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হয়। দালালমুক্ত করার চেষ্টা আমাদের আছে। ’ গ্রাহকদের অনেক অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন সকাল ৯টা থেকে সেবা দেওয়া শুরু করি, গত রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে সেবায় এমন তদারকি থাকে না। আমরা সিসি ক্যামেরা বসিয়ে তদারকি করছি। ’
মিরপুর বিআরটিএর কার্যালয়ে গতকাল দুপুরে হাজারো গাড়িচালকের ভিড় ছিল। এর আগে গত মঙ্গলবার নতুন লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন ৮০০ জন, ফিটনেস সনদ নেন এক হাজার ২০০ জন।
গতকাল কারাদণ্ড পাওয়া দালালদের মধ্যে রয়েছে মোরশেদ আলম (৪৫), কাজী তাজুল ইসলাম, মুন্না রায় (৪৫), ঝন্টু রায়, (৪০), আল আমীন (২৫), হেলাল (১৮), মো. মাহবুব (১৮), নাজির হোসেন (৩৫), মিলন মিয়া (২৭), মোশাররফ হোসেন (৩৫), হাবিবুর রহমান (৩৮), আতাহার (৬৮), আশিক (১৮), ফয়ছল (১৮) ও আব্দুল হালিম (২৩)।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে আকস্মিক পরিদর্শনে যান। ওই দিন কালের খবরকে লাইসেন্স ফিটনেসে টাকার খেলা শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এর পরই মন্ত্রীকে বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে যেতে দেখা গেছে। এর পরদিন গতকাল মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদল সেবা কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে। জানা গেছে, সড়কমন্ত্রী বিআরটিএর সেবা বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য পাচ্ছেন তাঁর মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। মন্ত্রী দুর্নীতি বন্ধে সক্রিয় আছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সচিব গেলেন সন্ধ্যায় : গতকাল সন্ধ্যায় পরিস্থিতি দেখতে মিরপুর বিআরটিএতে যান সড়কসচিব মো. নজরুল ইসলাম। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এহছানে এলাহী কালের খবরকে বলেন, সন্ধ্যায় দুটি গাড়ির ফিটনেস দেওয়া হয়নি। ৩৬টি আসনকে ৪৫টি আসন করায় একটির ফিটনেস দেওয়া হয়নি। অন্যটির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ছিল। গাড়ির অননুমোদিত উচ্চতা থাকায়ও ফিটনেস দেওয়া হচ্ছে না। সচিব মহোদয়ও বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে বলেছেন।
অফিস : ৪৪-ক, অতিশ দীপঙ্কর রোড, মুগদা, ঢাকা । সম্পাদকীয় কার্যালয় : আরএস ভবন, ১২০/এ মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইল : ০১৭৫৩-৫২৬৩৩৩ ই-মেইল : dainikkalerkhobor5@gmail.com
কারিগরি সহযোগিতায় ফ্লাস টেকনোলজি