।। মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন, কালের খবর ।।
অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ প্রায় আড়াই মাস চলছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের শাসন কাল খুব দীর্ঘ কাল হবে না এটা সুনিশ্চিত, তবে তাদের কিছু মানুষের কর্মকান্ড দেখে মনে হচ্ছে তারাও অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে।আসলে ব্যাপারটা তেমন না। এই সরকার পূর্বেকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো যদি মাত্র মাস তিনেক অবস্থান করতো, তাহলে তাদের অর্থনীতি নিয়ে অত চিন্তা না করলেও হতো। আপাত দৃষ্টিতে তারা বছর দেড় থেকে দুয়েক এই সিংহাসনে থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ রাষ্ট্র সংস্কারের স্বার্থে দেড় থেকে দুবছর ক্ষমতায় থাকাটা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। তাই দুবছর দেশের অর্থনীতি বেহাল অবস্থায় রাখা সম্ভব নয়, এর জন্য অর্থনীতিতে জরুরি ও আবশ্যকীয় বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। অর্থনীতিকে ন্যূনতম সুস্থ অবস্থায় টিকিয়ে রেখে এর পাশাপাশি যথাসম্ভব রাষ্ট্র সংস্কার করে মানবাধিকারের নিশ্চয়তা এনে অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা এই সরকারের প্রধান কাজ।একটা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার সূত্রপাত করা উপদেষ্টাদের পবিত্র দায়িত্ব।কিন্তু মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সেনাপতিরা মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে খেয়ে হারিয়ে ফেলছেন। হিন্দু ধর্ম মতে-শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরুর আগে পাণ্ডব পক্ষের বিচলিত অর্জুনকে বলেছিলেন “সেনাপতির মনোযোগের অভাব পরাজয়ের পূর্বশর্ত”। আজকে প্রধান উপদেষ্টা স্যারের সেনাপতিদের অবস্থা ও অনেকটা অমনোযোগী বলে প্রতিয়মান হয়, এবং তার সাথে তারা হয়তো ভুলে যান ফ্যাসিষ্ট শক্তি আবার ফেরার সুযোগ পেলে এদেশের স্বাধীনতা সার্বোভৌমত্ব সম্পূর্ন রুপে বিপন্ন হবে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে বিপন্ন অর্থনীতিকে রক্ষা করায় মনোযোগী হওয়া।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস করছে কোভিড মহামারির পর সবচেয়ে কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে চলতি অর্থবছরে এবং গতি হারাতে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত কয়েক মাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও শ্লথ হয়েছে।অর্থনীতিতে যেসব অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সরকারের উচিত সেগুলোর দিকে দ্রুত মনোযোগ দেওয়া।সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। তবে এটি প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাসের মধ্যবর্তী পয়েন্ট। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতি ঠিকমতো না চললে প্রবৃদ্ধি কমে হতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, আর খুব ভালো করলে হবে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২ শতাংশ।দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ায় যদি প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তাহলে তা হবে কোভিডের সময়ে অর্জিত প্রবৃদ্ধির চেয়েও কম। করোনোভাইরাস মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময়ে ২০১৯–২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল। এ কারণে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বন্ধ ছিল শিল্পের উৎপাদন কর্মকাণ্ড। মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য।
বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক নিয়ামক হতে পারে দুটি বিষয়। একটি সংস্থাটির কথায় উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে। অন্য বিষয়টি হলো দেশের বিভিন্ন এলাকার বন্যা, যা কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি সীমিত করে দেবে। এ কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সার্বিকভাবে কমবে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ।শতবে বাংলাদেশের অর্থনীতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা এখন অনিশ্চয়তা। ‘অনিশ্চয়তা যদি কাটানো না যায়, তাহলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের পথে হাঁটবেন না। অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। টাকাটা তাঁরা পকেটে রেখে দেন। তাই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে চেষ্টা করতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে।’বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তিনটি সূত্র থেকে এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যার কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতার পরও যা চলমান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তৃতীয়ত, জ্বালানি খাতের দীর্ঘদিনের সমস্যা। তবে অর্থনীতির সাম্প্রতিক শ্লথ গতি অবশ্য হঠাৎ আসেনি এটি উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্লথ হতে শুরু করে, যে ধারা চলতি বছরে আরেকটু জোরদার হতে পারে। তাছাড়া সম্প্রতি আমাদের অর্থনীতির তিনটি প্রধান খাত কৃষি, প্রবাসী আয় ও তৈরি পোশাক। এগুলো কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে পুঁজির ব্যবস্থা করতে হবে। সারের যাতে ঘাটতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর কর্মীদের বিদেশ গমন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে।’
দেশে প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে, যে অর্থনীতি এখন শতকরা ৮ থেকে ১০ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করতে পারত, তার কপালে কিনা এই অর্থবছরে জুটবে শতকরা ৪ ভাগ প্রবৃদ্ধির সান্ত্বনা পুরস্কার! বিশ্বব্যাংক সে রকম পূর্বাভাসই দিয়েছে। এই একটি বার্তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে সচেতন করার জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বড় বার্তা মূল্যস্ফীতির নিরন্তর দহন। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন যে মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে শতকরা ১ ভাগ কমেছে। কিন্তু তাতে মানুষের কষ্ট কমেছে কি না, সেটিই দেখার বিষয়। যাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও শাকসবজি কিনতে বাজারে যান, তাঁদের প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। কেউ বলছেন, আগেই ভালো ছিল। “এই আগেই ভাল ছিল” তা থেকে ‘এখন ই ভাল’ তা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বই সরকারের উপর অর্পন করা হয়েছে। যদিও অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তৎপর রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও। তিনি কয়েক দফা সুদের হার বাড়িয়েছেন, যা ঋণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে। তবে বিনিয়োগ কমে যাবে বৈকি। ষাটটির মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েগেছে, যা বিনিয়োগে মন্দক্ষুধার নির্দেশক। মূল্যস্ফীতি দমনে সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টারও ভূমিকা বিশাল কারণ বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে একটা বড় সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি রয়েছে।তবে আপাতত মনে হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমানে ইতিহাসের দুর্বলতম বিভাগ। এর কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বা সাফল্য নেই। এই বিভাগের আন্তরিক মনোযোগ ছাড়া উচ্চ মূল্যের তীব্রতা কমানো সম্ভব নয়। বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, তথ্য, যোগাযোগ, রেল ও নৌপরিবহন, স্থানীয় সরকার, জ্বালানি, বিচার, আইন ও অর্থ বিভাগগুলোর অখণ্ড মনোযোগই পারে মূল্যস্ফীতি কমাতে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক নয়। চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট নির্মূল করা শুধু স্বরাষ্ট্রবিষয়ক কাজ নয়, এতে অর্থনীতির উপকার অনেক বেশি। এই সরকার সেদিকে অখণ্ড মনোযোগ আনবে, এটিই প্রত্যাশা।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে,দেশের অর্থনীতির জন্য যে চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে সেগুলো হলো মূল্যস্ফীতি, যা কিছুটা কমলেও উচ্চহারে থাকবে; বহিস্থ খাতের চাপ, যার মূল কারণ প্রয়োজনের তুলনায় কম রিজার্ভ; আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কাজ করছে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনৈতিক গতিপথ কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কেবল বাড়ছেই।সরকারকে এব্যাপারে সঠিক সিদ্বান্ত নিতে হবে, যদি অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায় এবং প্রকৃতি শেষ পর্যন্ত আমাদের পক্ষে থাকে, তাহলে চলতি অর্থবছরে হয়তো ৫ শতাংশের একটু বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ।তবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশের দিকে যেতে।এবং চলতি অর্থবছরের সমস্যাগুলো থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে আগামী বছর অর্থনীতিতে আবার চাঙা ভাব ফিরে আসবে—এটা আমরা আশা করতে পারি।তবে তার আগে সরকারকে জরুরী বিষয় গুলোর ব্যাপারে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সিদ্বান্ত নিতে হবে,কোন কাজ আগে করবে আর কোন কাজ পরে করবে। সেই অনুযায়ী একটি রোড ম্যাপ ঠিক করতে হবে।তাহলে ই সাফল্য আসবে, এর পর রাজনৈতিক সরকার যে কাজ গুলো করতে আগ্রহ দেখায় না সেই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী জনহিতকর কাজ করে নজির রেখে যেতে পারে। তবে এ ট্রেন একবার লাইনচ্যুত হলে জাতির কপালে দুর্ভোগ আছে।
লেখক : কলামিস্ট ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
Email : msislam.sumon@gmail.com
অফিস : ৪৪-ক, অতিশ দীপঙ্কর রোড, মুগদা, ঢাকা । সম্পাদকীয় কার্যালয় : আরএস ভবন, ১২০/এ মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইল : ০১৭৫৩-৫২৬৩৩৩ ই-মেইল : dainikkalerkhobor5@gmail.com
কারিগরি সহযোগিতায় ফ্লাস টেকনোলজি