মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন, কালের খবর :
সদ্য ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার সরকারের ১৫বছরের আমল নামা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় চরম দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটে বিপর্যস্ত আজকে দেশের বিদ্যুৎ খাত। দেশের যে কয়টি খাতে সবচেয়ে বেশী দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বিদ্যুৎ খাত। নিজেদের লোকজনকে সুবিধা দিতে অপরিকল্পিত ভাবে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তার সাথে আইন করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ব্যবস্থা করা হয়েছে লুটপাটের। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি সরকারকে দিতে হয়, তাই হলো ক্যাপাসিটি চার্জ।আর এই ক্যাপাসিটি চার্জে আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে সামিটে গ্রুপের আজিজখান।২০২৩ সালের সেপ্টম্বরে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় ৪১তম স্থানে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত উদ্যোক্তা এবং সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান।ফোর্বস ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, আজিজ খানের নিট সম্পদের পরিমাণ ১.১২ বিলিয়ন ডলার বা ১১২ কোটি মার্কিন ডলার।আর ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর আদায়কৃত ক্যাপাসিটি চার্জের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর ডলারের বর্তমান বিনিময় হার (১১৮ টাকা) ধরে সিঙ্গাপুরে আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে ১৫ বছরে সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রাপ্ত ক্যাপাসিটি চার্জ ও আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ প্রায় সমান।
২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে ১৪ বছরে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার) কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সরকার ৯০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব যোগ করলে তা ১ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।পিডিবির তথ্য বলছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এই অঙ্ক ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৮৪ কোটি এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় পৌনে ৯ হাজার টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতে ব্যয় একলাফে ২৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। ওই বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অথচ এ সময় বেসরকারি তথা রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার) কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার কমেছে। পরের দুই অর্থবছরে প্রায় একই পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
ওই সময়ে স্বৈরাচার সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সামিটকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২ হাজার ১৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ১৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটিকে দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস। চতুর্থ স্থানে থাকা দেশি কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। পঞ্চম স্থানে থাকা রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে (আরপিসিএল) দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাংলা ক্যাট গ্রুপ নিয়েছে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। মাত্র তিন বছর আগে উৎপাদন শুরু হওয়া বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অপর একটি গ্রুপকে ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা এবং খুলনা পাওয়ার কোম্পানিকে (কেপিসিএল) ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানির ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের কাছে ও ৩৫ শতাংশ ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। ফলে খুলনা পাওয়ারের ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই গেছে সামিট ও ইউনাইটেডের কাছে। সিঙ্গাপুরের জন্য করা তালিকায় মুহাম্মদ আজিজ খানের অবস্থান ৪১তম হলেও ‘ফোর্বস’–এর করা বিশ্বের শত কোটিপতিদের তালিকায় তার স্থান দেখানো হয়েছে ২৫৪০তম। গত বছর মিঃ খানের নিট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।এ বছর সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় এক ধাপ এগিয়েছেন আজিজ খান। ফোর্বস-এর ২০২২ সালের সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় আজিজ খানের অবস্থান ছিল ৪২ নম্বরে।ফোর্বসের তৈরি করা সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আজিজ খানে প্রথম স্থান পান ২০১৮ সালে। ওই সময় তার নিট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৯১০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে কিছুটা কমার পর ২০২০ ও ২০২১ সালে তার নিট সম্পত্তি পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৯৫৫ মিলিয়ন ও ৯৯০ মিলিয়ন ডলারে।
শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে দেশের বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ।দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে বড় একটা নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে, আজিজ খান বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ‘কুইক রেন্টাল’ নামে পরিচিত বহুল বিতর্কিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান । আজিজ খান এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস ও আবাসন খাতের ব্যবসা আছে সামিট গ্রুপের। সামিটের অধীন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের যত ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর হোল্ডিং কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল।সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত। সে জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা করলেও এ কোম্পানির সম্পদের হিসাব করা হয় সিঙ্গাপুরে।১৯৯৭ সালে দেশের বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এটি এখন দেশের বৃহৎ বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৯ শতাংশই উৎপাদন করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। পরবরতিতে ইউনাইটেড পাওয়ারের সঙ্গে যৌথভাবে গড়ে তুলে খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড বা কেপিসিএল। বর্তমানে এ কোম্পানির ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের হাতে। ২০১০ সালে কেপিসিএল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ওই কোম্পানির অধীনে এক সময় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল, যার মধ্যে বর্তমানে দুটি চুক্তিভিত্তিক চালু রয়েছে। সামিটের বিদ্যুৎ সেক্টরে প্রসার বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে শর্ত অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ/ সরকার যখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সাথে চুক্তি করে তখন সে চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার শর্তটি জুড়ে দেয়া থাকে। এই চার্জ ডলারে পরিশোধ করা বা ডলারের বিনিময় হার অনুযায়ী পরিশোধের শর্ত থাকে। ফলে তা পরিশোধে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর আদায়কৃত ক্যাপাসিটি চার্জের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর ডলারের বর্তমান বিনিময় হার (১১০ টাকা) ধরে সিঙ্গাপুরে আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ১৫ বছরে সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রাপ্ত ক্যাপাসিটি চার্জ ও আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ প্রায় সমান।চলতি বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে জনগণের যে টাকা সরকার খরচে তার ৪৪ শতাংশই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর পকেটে যাচ্ছে।
প্রকল্প গ্রহণের আগে সঠিকভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি বা নির্মিত প্ল্যান্টসমূহে জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে ওইসব কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন হতো না।আর এই ৪৪% বেসরকারি খাতের অব্যবহ্রত বিদ্যুতের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জে এদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলো কর্ণধাররা ফুলে ফেপে সিংগাপুরের মতো দেশে শ্রেষ্ঠ ধন কুবেরের তালিকায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ও পারতো না।এখন প্রশ্ন এ থেকে পরিত্রাণ কি কখনো ই হবে না? সাড়ে ১৫ বছর ধরে “ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে বিনিয়োগ আসবে না বিদ্যুৎ খাতে” -এই মিথ্যা প্রচারনার মাধ্যমে লুটপাটের এক মহাউৎসব চলছিল খোদ স্বৈরাচারী হাছিনার নেতৃত্তাধীন এই মন্ত্রনালয়ে। এখন অনেক রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্র সংষ্কারের অংগীকার নিয়ে নতুন যে সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন তাদের সর্ব প্রথম কাজই হবে দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পনোরুদ্বারের জন্য এই সব দুর্নীতবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা , পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা। তাহলেই দ্বিতীয় স্বাধীতা সংগ্রামের সকল শহীদের আত্যা শান্তি পাবে।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
Email : msislam.sumon@gmail.com
অফিস : ৪৪-ক, অতিশ দীপঙ্কর রোড, মুগদা, ঢাকা । সম্পাদকীয় কার্যালয় : আরএস ভবন, ১২০/এ মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইল : ০১৭৫৩-৫২৬৩৩৩ ই-মেইল : dainikkalerkhobor5@gmail.com
কারিগরি সহযোগিতায় ফ্লাস টেকনোলজি