নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের খবর :
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারিক আদালত। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে এ দণ্ড দেন। মামলায় সাজা হওয়ার পর চারদিকে নানা প্রশ্ন উঠেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া কী অংশ নিতে পারবেন কি না। এ নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন।
বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেন খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে সরকার আসলে ভোট থেকে তাকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। খালেদা জিয়া নিজেও জেলে যাওয়ার আগে এমন অভিযোগ করেন।
সংবিধানের ৬৬ (২)(ঘ)অনুচ্ছেদে বলা আছে, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া ন্যূনতম দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে যোগ্য হবেন না। এ আইন অনুযায়ী খালেদা জিয়া ভোটে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারিয়েছেন; তবে আপিল করলে বিষয়টি হবে ভিন্ন। এ বিষয়ে সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, নিম্ন আদালতের সাজা নিয়ে আপিল হবে। সে ক্ষেত্রে বিচারাধীন অবস্থায় ভোটে অংশ নিতে বাধা নেই। নবম সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-১ আসন থেকে এভাবেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তার ১৩ বছর সাজা হয়েছিল।
রায়ের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনেও খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, তাকে ভোট থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টায় সরকার এ মামলার রায় দিচ্ছে। রায়ে সাজা হওয়ার পর খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবে কি না এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সংবিধানে বলা আছে, নৈতিক স্খলনের জন্য কারও যদি দুই বছরের অধিক সাজা হয়, তাহলে তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে এ ব্যাপারে দুটি রায় আছে, তাতে বলা আছে, আপিল যতক্ষণ না পর্যন্ত শেষ হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মামলা পূর্ণাঙ্গ স্থানে যায়নি, সে জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। এ ছাড়া আরেকটি রায় আছে, তাতে পারবেন না। এখন খালেদা জিয়া ব্যাপারে আপিল বিভাগ এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তাদের বিষয়।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি রংপুরে নিজের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেছিলেন, আমি খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি। এরশাদের অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ার পর এখন দেশবাসীর অপেক্ষার পালা মঞ্জুর হত্যাসহ এরশাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো নিজস্ব গতিতে চলে কি না। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয় যে, জনতা টাওয়ার মামলায় আপিল বিভাগ এরশাদের সাজা বহাল রাখলে তিনি ২০০০ সালের ২১ ডিসেম্বরে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং বিচারক তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। তাকে কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়ে চার দলের শীর্ষ নেতারা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে খালেদা জিয়ারও সই ছিল। এখন বিএনপি নেতারা যেমন বলছেন, সাজানো মামলায় খালেদাকে ফাঁসানো হয়েছে, সেদিন জাতীয় পার্টির নেতারাও দাবি করেছিলেন, চারদলীয় জোটে যাওয়ার কারণেই এরশাদ সরকারের রোষের শিকার হয়েছেন।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরশাদ অংশ নেন কারাগারে থেকে। আর ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলা, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাওয়া উপহারসামগ্রী আত্মসাৎ-সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলাসহ তিনটি মামলায় নিম্ন আদালতে দণ্ডিত (সাজার মেয়াদ ৩ থেকে ১৩ বছর) ছিলেন। কিন্তু সেই দণ্ড ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিম্ন আদালতের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে এরশাদ নির্বাচন করেন এবং সংসদ সদস্য পদও বহাল রাখেন।
জানা গেছে, বিচারিক আদালতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর মায়ার সাজা হয়েছিল। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় খারিজ করে দেন। দুদক হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ খারিজ করে নতুন করে শুনানির নির্দেশ দেন। এর অর্থ হচ্ছে, মামলাটি এখনো সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। কিন্তু সে কারণে মায়ার মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ যায়নি। আপিল করা অবস্থায় তিনি সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। কাজেই এখানে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর বিষয়টি একটি উদাহরণ হয়ে থাকছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক গতকাল খোলা কাগজকে বলেন, এটার সোজাসুজি কোনো উত্তর নেই। অনেক কিছুই হতে পারে। তবে বিভিন্ন সময়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, উচ্চ আদালতে আপিল থাকলে কেউ নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার কথা নয়। নবম সংসদের সদস্য থাকা এবং যিনি বর্তমান সংসদেরও সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মামলার রায় ও এর ঘটনাপ্রবাহও আমাদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগের হয়ে কক্সবাজার-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি আবদুর রহমান বদির তিন বছর সাজা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আপিল চলমান। বাস্তবতা হচ্ছে, তিনিও সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। কাজেই নিম্ন আদালতে সাজা হলেই কোনো ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না, বিষয়টি চূড়ান্ত নয় বলে ধরে নেওয়া যায়। সাজা চূড়ান্ত করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম গতকাল খোলা কাগজকে বলেন, বিষয়টি নির্ভর করবে আদালতের ওপর। উচ্চ আদালত যদি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় নিম্ন আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন তাহলে তার নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। নিম্ন আদালতের দণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদাহরণ বাংলাদেশে আছে। বর্তমান সংসদেও কয়েকজন এমপি রয়েছেন যারা নিম্ন আদালতে মামলার রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন কিন্তু উচ্চ আদালতে আপিল করে স্বপদে বহাল রয়েছেন।
সুতরাং, নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টের সাজার ওপর নির্ভর করে অতীতে কারও সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়নি বা কাউকে সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পরও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মহীউদ্দিন খান আলমগীর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও আবদুর রহমান বদি উচ্চ আদালতে আপিল করে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তারা এখন কেউ মন্ত্রী পদে, কেউ সংসদ সদস্য পদে অধিষ্ঠিত। সে ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়া খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে আপিল করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না কেন ?
কালের খবর/১৯/২/১৮
অফিস : ৪৪-ক, অতিশ দীপঙ্কর রোড, মুগদা, ঢাকা । সম্পাদকীয় কার্যালয় : আরএস ভবন, ১২০/এ মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইল : ০১৭৫৩-৫২৬৩৩৩ ই-মেইল : dainikkalerkhobor5@gmail.com
কারিগরি সহযোগিতায় ফ্লাস টেকনোলজি