আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত বিতর্কিত ব্যবসায়ী নেতা হেলেনা জাহাঙ্গীরের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তালিকা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার সঙ্গে কাদের যোগাযোগ ছিল, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এতে হেলেনার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

বেরিয়ে আসছে অনেকের নাম। তদন্তে উঠে আসছে অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের বিষয়টিও। তাদের বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই এসব ব্যক্তির নাম প্রকাশ করতে নারাজ তদন্তসংশ্লিষ্টরা। গতকাল শনিবার রিমান্ডের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে হেলেনার। প্রথম দিনেই তদন্তসংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এমন বহু তথ্য দিয়েছেন হেলেনা। এদিকে অনুমোদনবিহীন আইপি টিভির আড়ালে হেলেনার চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। সাংবাদিক নিয়োগ দিয়েই তিনি হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের অর্থ। সংবাদ প্রকাশের বিনিময়ে ওই সব সাংবাদিকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ আদায় করতেন হেলেনা।

ঢাকাসহ সারা দেশেই আছে তার একাধিক সিন্ডিকেট। মূলত চাঁদাবাজির জন্যই জয়াযাত্রা টিভি চালু করেন তিনি। তার টিভিতে কখনোই বেতন দেওয়া হতো না সাংবাদিকদের। জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা এসব তথ্য জানিয়েছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কালের খবরকে  জানিয়েছেন।

তারা বলেন, হেলেনা স্বীকার করেছেন যে তিনি উচ্চাভিলাষী জীবনের লোভেই ফেইসবুক ও জয়যাত্রা টিভির মাধ্যমে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে সবার নজর কেড়েছেন। এ ছাড়া কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের বিষয়েও তথ্য দিয়েছেন।

আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতার তালিকায় রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী : তদন্তসংশ্লিষ্টরা কালের খবরকে  জানান, র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে তার পাঁচটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তা ছাড়া ঢাকার গুলশান, উত্তরা ও মিরপুরে আছে ১৬টি আলিশান ফ্ল্যাট। তিনি ৮টি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ডজনখানেক ক্লাবের সদস্য। নিজের কখনো ৬টি গাড়ি আবার কখনো ৮টি গাড়ি থাকার কথা উল্লেখ করেন। এসব বিষয় তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, তার (হেলেনা) আয়ের উৎস সম্পর্কে সিআইডি কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখবে। জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর র‌্যাবকে আরও জানিয়েছেন, সম্প্রতি তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় ছিলেন। বেশ কয়েকবার তিনি নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। তিনি শুধু নিজের অবস্থান উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এ ধরনের অপতৎপরতা চালিয়েছিলেন।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী হেলেনাকে সবধরনের সহায়তা করতেন। এমনকি কয়েকজনের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্কও আছে। দেশের এমপি-মন্ত্রীদের না চিনলেও হেলেনা জাহাঙ্গীরকে দেশের মানুষ সবাই চেনে।

হেলেনাকে রক্ষায় তৎপর প্রভাবশালীরা : গুলশান থানায় তিন দিনের রিমান্ডে থাকার প্রথম দিনে হেলেনাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নিজের জয়যাত্রা টিভিতে টকশো ও আলোচনায় তার লাগামহীন বক্তব্যের কারণ নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রথমে সখ্য তৈরি ও পরে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করতেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। যাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তাদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের দিয়েও প্রতারণার মামলা করানো হবে বলে জানান পুলিশ ও র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা। তারা বলেন, তাকে (হেলেনা) বাঁচানোর জন্য একটি প্রভাবশালী চক্র কাজ করছে। তারা ওপরের মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে তথ্য মিলেছে। ওই চক্রটির সঙ্গে দেশের বাইরে থেকেও কয়েকজন ইন্ধন দিচ্ছেন। চক্রটিকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন কালের খবরকে  বলেন, ‘জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ৭০ থেকে ৮০ জন যোগদান করেন। দীর্ঘদিন কাজ করার পরে ২০-২৫ জনকে ছাড়া বাকি সবাইকে বেতন না দিয়েই ছাঁটাই করেন হেলেনা। প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আইডি কার্ডের বিনিময়ে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশেও জয়যাত্রার প্রতিনিধি ছিলেন, তাদের সবার কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতেন তিনি। দেশ-বিদেশে জয়যাত্রা টেলিভিশনের যত প্রতিনিধি রয়েছেন, তা দেশের অন্য কোনো স্যাটেলাইট টেলিভিশনের নেই। কিছুদিন আগে ওই টেলিভিশনের একজন জেলা প্রতিনিধি চাঁদাবাজির সময় পুলিশের হাতে আটক হন। ’

হেলেনার মতো তার প্রতিনিধিরাও চাঁদাবাজি করতেন এমন ধারণার কথা জানিয়ে খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘আলোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীরের ছিল ২০ লাখ ফলোয়ারের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজ। তার পেজ ও জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশনের পেজ মনিটরিংয়ের জন্য ছিল শক্তিশালী সাইবার টিম। তার পেজে অযাচিত ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এলেই সাইবার টিম তাদের ঘায়েল করত। জয়যাত্রা টিভির অফিসে অভিযানের সময় র‌্যাব জানতে পারে হেলেনা জাহাঙ্গীর একটি শক্তিশালী সাইবার টিম পরিচালনা করতেন। এই টিমে ১৫-২০ জনের নাম পাওয়া গেছে। এই সাইবার টিম একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তার নামে প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। তারা নিজেরাই লাইক, শেয়ার ও হেলেনার পক্ষে পজিটিভ কমেন্ট করতেন। এমনকি হেলেনার বিরুদ্ধে যদি কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করতেন তৎক্ষণাৎ সাইবার টিম তাদের অপমান করে ঘায়েল করত। ’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষ যদি মনে করে এ মামলাটির তদন্ত র‌্যাব করবে, তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আবেদন করব। তবে তা ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে হবে। ’

জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনে আসত বিদেশ থেকে অর্থ : র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী ১৯৯০ সাল থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। পরে বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সঙ্গে পার্টনারশিপের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। ২০১২ সাল থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতেন। ওই ফাউন্ডেশনের নামে হেলেনা দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন। দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রথমে সখ্য ও পরে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায়ই ছিল তার মূল পেশা। হেলেনা সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির জন্য থেমে থাকেননি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাকেই প্রয়োজন হয়েছে তাকে তিনি ঘায়েল করেছেন বলে র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান।

তিনি আরও বলেন, হেলেনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছেন শুধু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, যা তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, জনগণের মধ্যেও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

হেলেনা নিয়ে মুখ খুললেন সেফুদা : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুল আলোচিত অস্ট্রিয়াপ্রবাসী সেফাত উল্লাহ ওরফে সেফুদা হেলেনাকে নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার টাকা নয়, হৃদয়ের লেনদেন। ’ গতকাল দুপুরে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি এ কথা বলেন। সেফুদা আরও বলেন, ‘র‌্যাব বলেছে আমি নাকি হেলেনা জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিই কিংবা সে নাকি আমাকে টাকা-পয়সা দেয়। এ রকম কী কী জানি বলেছে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার টাকা-পয়সার লেনদেন নেই। সম্পদের লেনদেন নেই। হৃদয়ের লেনদেন আছে। হেলেনা জাহাঙ্গীর লাস্ট কালকেও আমাকে বলেছে, দাদা, আই লাভ ইউ। আমি বলেছি লাভ ইউ টু। কারণ লাভ ইজ পাওয়ার। আপনারা জানেন ভালোবাসা আমার আদর্শ। ’ এ সময় লাভ ইজ পাওয়ার লেখাসংবলিত এবং তার ছবি সংযুক্ত টি-শার্ট দেখিয়ে সেফুদা বলেন, ‘হাজার হাজার লোক এই টি-শার্ট কিনছে। আই লাভ হেলেনা জাহাঙ্গীর। হোয়াই নট, হোয়াই আই শুড নট লাভ হেলেনা জাহাঙ্গীর? ’ এরপর অবশ্য তিনি বলেন, ‘হু ইজ হেলেনা জাহাঙ্গীর? আই ডোন্ট নো, আই ডোন্ট নিড টু নো। অনলাইনে প্রায় তিন বছরের কম সময় ধরে আমি তাকে চিনি। মানে আমাকে সে আবিষ্কার করেছে। ’

সেফুদা বলেন, ‘হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তারের সময় চেহারায় কোনো অনুতাপ নেই। অনুতাপ থাকবে কেন। তিনি কঠোর পরিশ্রমী একজন শিল্পোদ্যোক্তা। নিজের পরিশ্রমের ফসল আজ তার কোটি কোটি টাকা, অনেকগুলো শিল্প, অনেক বাড়ি-গাড়ির মালিক। তিনি সমাজের ওপর স্তরের মানুষ। টাকা-পয়সা না থাকলে তার কোনো দাম নেই। ’

সর্বশেষ ৩টি মামলা দায়ের : হেলেনার বিরুদ্বে এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে। পল্লবী থানায় দায়ের হওয়া জয়যাত্রার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। গত শুক্রবার রাতে পল্লবী থানায় র‌্যাব বাদী হয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৫, ৫৫, ৭৩ ধারায় মামলাটি দায়ের করে। এর আগে তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দুটি মামলা হয়। একটি মামলা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের চারটি ধারায় আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই মিরপুরে হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা টেলিভিশন স্টেশন পরিচালনা করছিলেন। র‌্যাব-৪-এর অভিযানে সেটি সিলগালা ও অবৈধ মালামাল জব্দ করা হয়