পাড়া-মহল্লায় নীরব আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়
করোনাকালে ‘রাজনীতিকরা’ মাঠে নেই
স্টাফ রিপোর্টার, কালের খবর :
দেশজুড়ে ভয়াবহ সংক্রমণের দানবীয়রূপে রূপ নিচ্ছে করোনা। সরকারের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ আরোপ করেও জনগণকে সচেতন করতে না পারায় দিনকে দিন আরো ভয়ঙ্কর রূপ দেখাতে শুরু করেছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। এ সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া অন্যসব অফিস-আদালত বন্ধ, যান্ত্রিক যানবাহনে যাত্রী বহনও নিষিদ্ধ। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠে আছে সশস্ত্র বাহিনী। জনসাধারণকে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। রাস্তায় বেরিয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে করা হচ্ছে গ্রেফতার জরিমানা। তবে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান কঠোর বিধিনিষেধে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ থাকলেও রাজধানীসহ সারাদেশে তেমন কোনো সাহায্য পাচ্ছে না নিম্নআয়ের মানুষরা। আগের মতো কেউ খোঁজখবরও নিচ্ছেন না তাদের। গত বছরের ৮ মার্চ করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর সংকটে পড়া মানুষদের পাশে থেকে খাদ্যসামগ্রী ও নগদ টাকা দিয়ে সহায়তা করতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ের নানা সংগঠনের কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে তৎপরতা ঢাকাসহ সারাদেশেই দেখা গিয়েছিল। করোনাকালে ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে সরব ছিল পাড়া-মহল্লার আওয়ামী লীগ-যুবলীগসহ সরকারদলীয় সহযোগী সংগঠনগুলোর শাখাগুলোও। ওই বছর সরকারি তৎপরতাও ছিল বেশ। শুধু তাই নয়, গতবার বড় রাস্তার ধারে, ফুটপাতে বসে থেকেও সহায়তা পেয়েছিল নিরন্ন মানুষ। এবার কঠিন সংকটে পড়া অসহায়-ছিন্নমূল কর্মহারা মানুষগুলোর পাশে যুবলীগের উদ্যোগের ওয়ার্ডগুলো রান্না করা খাবার ও কিছু আর্থিক সহযোগী করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তাদের সাহায্যে তেমন কোনো তৎপরতাই দেখা যাচ্ছে না। খাবারের অভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করছেন এসব অসহায় মানুষ। সরকার মানুষের পাশে দাঁড়ালেও বিত্তবানরা এখনো ‘পকেট’ খুলেননি। বন্ধ রয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যালয়ও। তবে তাদের খাবার দিতে যারা গতবার মাঠে নেমেছিলেন, সেই স্বেচ্ছাসেবীরা বলছেন, নানাজনের অর্থ সহায়তা নিয়ে এই কাজ করেন তারা। কিন্তু এবার সহায়তা তেমন মিলছে না। এটা যেমন রাজধানীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অন্য জেলাগুলোতেও তাই। মহামারী দীর্ঘায়িত হওয়ায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পেরিয়ে এখন মধ্যবিত্তের সংসারেও ধাক্কা লেগেছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারীর কারণে বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারে গড় মাসিক আয় কমেছে, আর ৩১ শতাংশ পরিবারে ঋণ বেড়ে গেছে। দৃশ্যত নিরন্নের সহায়তায় এগিয়ে আসা অনেকের জীবনেই এখন সংকট নেমেছে, যার প্রভাবে টান পড়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের তহবিলে। সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মানবিক সহায়তা ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং ২৩ হাজার ৬৩০ টন চাল বিতরণের ঘোষণা এরই মধ্যে দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে সেই টাকা ও চাল কবে নাগাদ কর্মহীন মানুষের কাছে পৌঁছাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে সরকারের সহায়তা পাওয়া গেলেও কীভাবে পেতে হয় তাও জানে না অসহায় মানুষদের অনেকেই। গত ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় বিধিনিষেধের নামে লকডাউন। কয়েকদফা এই বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়ালেও তাতে করোনা সংক্রমণ কমেনি। এর পর গত ১ জুলাই থেকে সারাদেশে একযোগে চলছে কঠোর লকডাউন। এতে সরকারি-বেসরকারি অফিস, মার্কেট বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে দিনমজুর ও ভাসমান মানুষরা। রিকশা চালু থাকলেও যাত্রীর অভাবে রোজগারহীন অবস্থায় পড়েছে এর চালকরাও। গত কয়েকদিন সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান, মালিবাগ, বিজয়নগর, শাহবাগ, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর-বনানী, ডেমরা, যমুনা ফিউচার পার্ক, রামপুরা ও কুড়িল বিশ্ব রোড, কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে নিম্ন আয়ের মানুষরা বসে রয়েছে। তাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তারা সকলেই কেউ যদি খাবার দেয়, সেই আশায় অপেক্ষা করছে। মালিবাগ রেলগেটের পাশে বসে থাকা মো. কুদ্দুস মিয়া বলেন, কাম (কাজ) নাই ১১ দিন, খামু (খাব) কী? কেউ দিলে খাই, না দিলে বসাই (বসে) থাকি। তিনি জানান, সে দীর্ঘদিন ধরে রংয়ের কাজ করতেন। এই লকডাউনের আগে কয়েকদিন কাজ করেছিল। বর্তমানে তার কোনো কাজ নেই। পরিবারের ৬ সদস্যকে নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিন কাটছে। তাই রেলগেটের সামনে বসে থাকে। কেউ ত্রাণ দিলে তা নিয়ে বাসায় যাবে। ভ্যানচালক আবুল হোসেন বলেন, এক বছর আগের কথা, করোনাভাইরাস মহামারীর সবে শুরু, তখন অনেকেই কড়াইল বস্তিতে এসে চাল-ডাল, বাচ্চাদের খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন। বছর গড়িয়ে আবার চলছে এখন লকডাউন। কিন্তু এবার তেমন করে কেউ আসেনি। গত বছর হঠাৎ বাড়িতে আইসা টোপলা দিয়া গেল। বাচ্চা আছে শুইনা দুধের প্যাকেটও দিল। আশপাশের সব বাড়িতেই দিছে। এই বছর মানুষ আরো বেশি কষ্টে আছে। এহনও এরম কেউ টোপলা নিয়া আসে নাই। তবে অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার পরিকল্পনা নিয়ে নিজ এলাকা ডেমরা ও ৬৮নং ওয়ার্ডে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান পলিন। কথা হয় তারা সাথে। মাহমুদুল হাসান পলিন জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তার নির্দেশনায় আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অভাবী-কর্মহীন মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাহলেই সোনার বাংলা স্বার্থক হবে। একইভাবে ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু স্বল্পপরিসরে নিজ এলাকায় হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাল-ডাল ও আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী নীরবে বিতরণ করছেন। তার ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ও প্রতিদিন খোলা রেখেছেন তিনি। বিচ্ছিন্নভাবে আওয়ামী যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রান্না করা খাবার বিতরণ করছেন। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এইচ এম রেজাউল করিম রেজার উদ্যোগে টিকাটুলি বস্তিতে ১০০০ অসহায়-দুস্থদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার ১৪৮/৭ দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী ১২০৪ ঠিকানায় অবস্থিত ৫০নং ওয়ার্ড যুবলীগ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় অসহায়দের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা প্যাকেট তৈরি করছেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সভাপতি আরিফ হোসেনসহ আরো কয়েকজন কর্মী। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, দেশজুড়ে লকডাইন চলছে, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে আগামীকাল সোমবার ৫ শতাধিক খাবার বিতরণ করা হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে খাবার বিতরণ করবেন কেন্দ্রীয় যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল। কথা হয় মোল্লা বাড়ি মসজিদের পাশে অবস্থিত ৬৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের কার্যালয়ে বসে আড্ডারত কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে। লকডাউনে কি করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ৬৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান উদ্দিন মিয়া বলেন, কর্মীদের নিয়ে দুস্থদের বাড়ি বাড়ি নিত্যসামগ্রী বিতরণ করছি। সকাল থেকে ক্লান্ত, তাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। একইকথা বলেছেন ৬১ নং (ধনিয়া বেলতলা কার্যালয়ে) ওয়ার্ড যুবলীগের আহ্বায়ক শেখ মো. রুবেল। তিনি বলেন, সরকারের ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর পর থেকে যতটুকু সম্ভব সাধ্যমতো ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। কথা হয় ৩৯ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হাজী মো. রমজান এবং সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ ফয়সাল জনের সাথে। গতকাল শনিবার ব্যাগে করে নিজ ওয়ার্ডের দুস্থদের বাড়ি বাড়ি তরিতরকারি পাঠাতে দেখা গেছে। এদিন প্রায় ৪৬টি পরিবারের মাঝে আলু, ভেন্ডি, বেগুন ও শাকসবজি পাঠিয়েছেন তারা। তবে এদিন ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যালসহ ওয়াড-ইউনিটের কার্যালয়গুলোও সুনসান নীরবতা দেখা গেছে। এসব কার্যালয়ে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। তবে ২০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সহ-দফতর সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার মন্টু বলেন, লকডাউনে কার্যালয়ে কেউ আসেন না, তাই বন্ধ রয়েছে। শনিবার মসিজীবী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খানের সাথে দেখা হয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ এলাকায়। তবে বন্ধ রয়েছে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও। শুধু তাই নয়, সারাক্ষণ ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে থাকা মা. মোমিনুল ওরফে টুপি বাচ্চু ও তার ছেলে মো. সুমন আলম জানান, গত কয়েকদিন যাবত দেখা মেলেনি কেন্দ্রীয় ও নগরের কোনো নেতার। তবে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ২ বছর ৬ মাস ধরে সিকুইরেটির দায়িত্বে থাকা মো. সামসুল হক বলেন, আগে এই কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় ও থানা-ওয়ার্ড নেতাদের পদচারণায় সরব ছিল। করোনার কারণে এখন কেউ আসেন না।
অফিস : ৪৪-ক, অতিশ দীপঙ্কর রোড, মুগদা, ঢাকা । সম্পাদকীয় কার্যালয় : আরএস ভবন, ১২০/এ মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইল : ০১৭৫৩-৫২৬৩৩৩ ই-মেইল : dainikkalerkhobor5@gmail.com
কারিগরি সহযোগিতায় ফ্লাস টেকনোলজি