বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন
গাড়ির চাকা ঘোরে পুলিশের ইশারায়
সংকেত বাতি আছে, তবু ট্রাফিক পুলিশ। আইন না মানার প্রবণতা এবং আইন প্রয়োগের শৈথিল্য মিলিয়ে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা কাজ করছে না। গতকাল মৎস্য ভবনের মোড়ে।
এম আই ফারুক আহমেদ, কালের খবর :
লালে থামুন, হলুদে দেখুন আর সবুজে চলুন। সড়কের ট্রাফিক সিগন্যালের ভাষাটা এমনই। কিন্তু রাজধানী ঢাকার সড়কের ট্রাফিক সিগন্যাল একেবারেই উল্টো। সিগন্যালের নিচে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশের হাত উঠলে গাড়ি থামে, আবার ইশারায়ই চাকা ঘোরে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল হওয়ায় কখনো লাল বাতিতেও চলে গাড়ি, সবুজে আবার দাঁড়িয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো চালকের চোখ থাকে না স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে, ট্রাফিক পুলিশের হাত নাড়ানাড়ির কসরতই তাঁদের কাছে সিগন্যাল। বছরের পর বছর এমন অদ্ভুতুড়ে নিয়মেই চলছে রাজধানীর সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। হতাশার খবর হলো এটা থেকে বেরিয়ে আসার বাস্তব কোনো পরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান নয়।
স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতিগুলোকে কাজে লাগানো না হলেও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের নামে বছর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। নেওয়া হয় নতুন নতুন প্রকল্প। সময়ের ব্যবধানে প্রকল্পগুলো হয়ে ওঠে ‘মাকাল ফল’।
ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের মাধ্যমে ৭০টি ইন্টারসেকশনে (একাধিক সড়কের সংযোগস্থল) স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। পরে ২০১২-১৩ অর্থবছরে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের মাধ্যমে সেই ৭০টি ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগন্যালগুলো উন্নয়ন, অচলগুলো সচল করা এবং সিগন্যালগুলো পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া এই কেইস প্রকল্পের আওতায় নতুন করে আরো ২৯টি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। আবার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এগুলোর মধ্যে ৪৩টি ইন্টারসেকশনের সিগন্যাল হেড সচল করা হয়। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকাভুক্ত ৫৩টি ইন্টারসেকশনের সিগন্যালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আর ৩৫টি বুঝিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে। এর পর থেকেই এসব সিগন্যালের রক্ষণাবেক্ষণ ও বিদ্যুতের খরচ চালিয়ে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন। তবে সেই খরচ কত, হিসাবটা দিতে পারেনি কেউ।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের সুপারিনটেনডিং ইঞ্জিনিয়ার কাজী মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘আমার বিভাগ ট্রাফিক নিয়ে কাজ করলেও সিগন্যালটা আমরা দেখি না।’ তিনি নিজে কিছু না বলে দেখিয়ে দেন বিদ্যুৎ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাকে।
এই বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহতাব আহমেদ বেশ কয়েক দিন টালবাহানার পর কালের খবরকে বলেন, ‘ভাই আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করেন। আমি কিছু জানি না। হিসাব অনেক জটিল। আমার ওপর বস আছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।’
বিদ্যুৎ বিভাগের আরেক প্রকৌশলী মাছুদ করিম বলেন, ‘আমি দায়িত্বে এসেছি মাত্র ১৫ দিন হলো। এখনো কিছুই বুঝে পাইনি। তাই কিছু বলতে পারছি না।’ প্রয়োজনে সময় নিয়ে তথ্য দেওয়ার কথা বললে তিনি জানান, ওপরের নির্দেশ ছাড়া তিনি কোনো তথ্য দিতে পারবেন না।
তবে সূত্র বলছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকাভুক্ত ৫৩টি ইন্টারসেকশনের একটিও কাজ করে না। এর মধ্যে গুলিস্তান মোড়, জিরো পয়েন্ট, কাকরাইল, মৎস্য ভবন, ধানমণ্ডি, সাইন্সল্যাব, আজিমপুর ও পান্থপথের মতো ২৭টি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়ার কারণে ট্রাফিক সিগন্যালগুলো বন্ধ রয়েছে। এর বাইরে বেইলি রোড, রমনা, জিগাতলা, মৌচাক ও মালিবাগ এলাকায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর রয়েছে আটটি। এ ছাড়া চারটি ইন্টারসেকশনে সিগন্যাল হেডগুলো প্রায় অচল হওয়ার পথে। আর মেট্রো রেলের কারণে তুলে নেওয়া হয়েছে ৯টি ইন্টারসেকশনের ট্রাফিক সিগন্যাল।
এদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৫টি ইন্টারসেকশনের মধ্যে সচল আছে মাত্র ৯টি। বাকিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই সড়কের উন্নয়নকাজ ও মেট্রো রেলের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছে। আর মোহাম্মদপুর এলাকার ট্রাফিক সিগন্যাল সচল থাকলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ এটিকে বন্ধ করে রেখেছে।
এসব ট্রাফিক সিগন্যালে কেন কাজ করছে না এবং এসবের রক্ষণাবেক্ষণ কিভাবে হচ্ছে, প্রকল্পের আওতায় ট্রাফিক সিগন্যালে কত টাকা ব্যয় হয়, এসবের উত্তর খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় কেইস প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি কালের খবরকে বলেন, ‘শুধু কয়েকটি ইন্টারসেকশন উন্নতি করে ট্রাফিক সিস্টেমের উন্নতি করা সম্ভব না। উন্নতি করতে হলে পুরো একটি করিডর ধরে উন্নতি করতে হবে। এখন মেট্রো রেলসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বেশির ভাগ ট্রাফিক সিগন্যাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি প্রকল্পের শেষ তিন মাস দায়িত্ব পালন করেছি। তাই প্রকল্পে মোট কত ব্যয় হয়েছে, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। বর্তমানে সিগন্যালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্ব, কিভাবে তা করছে আমার জানা নেই। তবে আমার নিয়ন্ত্রণে প্রকল্প চলার সময় তদারকির জন্য প্রতিদিনই দুজন টহল দিতেন।’
সড়কে ট্রাফিক পুলিশের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে পুলিশের দিক থেকে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে পারি না। আপনি এটি পুলিশ বিভাগকেই জিজ্ঞেস করেন।’
আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে মোবারক (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় বাতি দিয়ে কোনো দিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। বিদেশি টাকা এদিক-সেদিক করতে আরো কত কিছু করা হবে।’
গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের সামনে দায়িত্বে রয়েছেন শাহবাগ জোনের সার্জেন্ট মো. মোকাররম হোসেন। সিগন্যাল হেড থাকার পরও কেন হাতের ইশারায় গাড়ি থামাতে বা চলার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিগন্যাল পুরোপুরি বাতির ওপর নির্ভরশীল হতে সময় লাগবে। সেটা দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের বিষয়। তা ছাড়া এখানে বেশির ভাগ সিগন্যালের বাতিগুলোই নষ্ট। আবার কোন রোডে চাপ কেমন, তা দেখারও একটি বিষয় আছে।’
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে হওয়া এই কেইস প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার পর তা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে হস্তান্তর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা এখনো হয়ে ওঠেনি। ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের এক বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সিগন্যালগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ট্রাফিক বিভাগ এখনো প্রস্তুত নয়। সিগন্যালগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষায়িত জনবল গঠনের প্রয়োজন রয়েছে।
সূত্র বলছে, ডিএমপির সুপারিশ অনুযায়ী ৩৯ জন জনবলের একটি টেকনিক্যাল ইউনিট গঠনের প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে অনুমোদিত হয়েছে। জনবল নিয়োগের জন্য সরকারি কর্ম কমিশনের কাছে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে। জনবল নিয়োগের পর ট্রাফিক সিগন্যালগুলো পুরোপুরিভাবে পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া কথা রয়েছে।
ডিএমপির (ট্রাফিক) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মনিবুর রহমান কালের খবরকে বলেন, ‘ট্রাফিক সিগন্যালের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের সময় রিমোর্ট কন্ট্রোলগুলো ঠিকমতো অপারেট করা যায়নি। পরে রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো না হওয়ায় সেগুলো অচল হয়েছে। এখন কিভাবে জিনিসটাকে সচল করা যায়, তা নিয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাদের কাছ থেকে সিগন্যালগুলো এখনো বুঝে নেওয়া হয়নি।’
সড়কে পুলিশের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালকে পুলিশের দিক থেকে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে কি না—এর জবাবে পুলিশের এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘এমন কথার কোনো ভিত্তি নেই। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দুই ধরনের কাজ—একটি অপারেশনাল, আরেকটি টেকনিক্যাল। সিগন্যালগুলো স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাওয়ার পর টেকনিক্যাল কাজটি সহজ হবে। কিন্তু তখনো অপারেশনাল কাজটি পুলিশকেই চালিয়ে যেতে হবে।