এমন আশ্চর্যজনক ভাগ্যবদল ঘটেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার অর্ধশত কয়লা ও পাথর ব্যবসায়ীর। এই দুটি জেলার সীমান্তের ১৩টি শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে ভারত থেকে কয়লা-পাথর আমদানির সুযোগে তাঁরা করে চলেছেন বিরাট কারসাজি। ব্যাংকের এলসির চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কয়লা শুল্ক না দিয়ে আমদানি করে একেকজন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে তাঁরা সরকারকে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে চলেছেন।
তাঁদের একজন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের বড়ছড়া গ্রামের মৃত মফিজউদ্দিন মোল্লার ছেলে আলখাছ উদ্দিন খন্দকার। ‘খন্দকার অ্যান্ড ব্রাদার্সের’ মালিক। একসময়ের দিনমজুর আলখাছ উদ্দিন তাহিরপুর ও সুনামগঞ্জ শহরে তিনটি আলিশান বাড়ি, মার্কেট, জমি ব্যবসাসহ কয়েক শ কোটি টাকার মালিক। বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি ছেড়ে এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা। হয়েছেন তাহিরপুর কয়লা ও পাথর আমদানিকারক সমিতির সভাপতি। আলখাছ কয়লা আর পাথর ব্যবসার আড়ালে শুল্ক কারসাজি করেই কাঁড়ি কাঁড়ি সম্পদ বানিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা থেকে মামা ছায়েদ আলীর হাত ধরেই ১৯৭৫ সালের পর তাহিরপুরের বড়ছড়ায় আসেন আলখাছ ও তাঁর ভাইয়েরা। সেখানের বিসিএসআইআরের অধীনে চুনাপাথরখনিতে দিনমজুর হিসেবে তিন ভাই কাজ করতেন। বড়ছড়া সীমান্ত দিয়ে কয়লা আর পাথর আমদানি শুরু হলে অল্প অল্প করে এই আমাদানিতে নামেন। ১০০ টন আনার এলসি করে শত শত টন আনা শুরু করেন শুল্ক না দিয়ে। আলখাছ ও তাঁর দুই ভাই রিয়াজ উদ্দিন খন্দকার ও গিয়াস উদ্দিন খন্দকার লিটন দুই দশকের ব্যবধানে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তাঁরা চড়েন প্রাডো গাড়িতে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁরা পাথর ও কয়লা ব্যবসায় একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করেন।
২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও একটুও কমেনি আলখাছ সিন্ডিকেটের দাপট। ডিগবাজি দিয়ে আলখাছ এখন আওয়ামী লীগ নেতা। বাগিয়ে নিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও। টাকার জোরে ছেলে মঞ্জুর খন্দকারের জন্য জেলা যুবলীগের পদও বাগিয়ে নিয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুল্ক ফাঁকির বদৌলতে আলখাছ তাহিরপুরের বড়ছড়া শুল্ক স্টেশনের পাশেই কিনেছেন ৩০ বিঘা জমি, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। বড়ছড়ায় ৩০ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করেছেন দোতলা বাড়ি, সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগরে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে খন্দকার হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শহরের আলীপাড়ায় তিন একর জমির ওপর বিলাসবহুল অট্টালিকা এবং মসজিদ, পুকুর ও খেলার মাঠ রয়েছে এর সঙ্গে। এই বাড়ি ও জমির মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আর শহরের মধ্যপাড়ায় আছে খন্দকার মার্কেট, যার আনুমানিক মূল্য ১১ কোটি টাকা। সুনামগঞ্জ শহর ও তাহিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে আলখাছের রয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ।
তাহিরপুর উপজেলার আলকাছই শুধু নন, কয়লা আমদানির শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মোবারক এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুস সামাদ ওরফে সামাদ মুন্সি। একসময় সিলেট শহরের মাঝেরটিলা এলাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। তাহিরপুর ও সুনামগঞ্জ শহরে কিনেছেন জমি, বাড়ি ও মার্কেট। সামাদ মুন্সি কিছুদিন মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। তার সহপাঠী ছিলেন চারাগাঁও গ্রামের আব্দুস সাত্তার। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘খুবই কষ্ট করত ওরা। কয়লা ব্যবসা করেই এখন কোটি টাকার মালিক।’
ময়মনসিংহ থেকে তাহিরপুরে এসে দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন বর্তমানে স্বর্ণা এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুল কুদ্দুস মিয়া ওরফে বেল কুদ্দুস। তিনি তাহিরপুর উপজেলায় বাড়ি করেছেন, বাদাঘাট বাজারে ১৫ শতাংশ জমির ওপর মার্কেট এবং সুনামগঞ্জ ও সিলেটে কিনেছেন অর্ধশত কোটি টাকার জমি। আর বড়ছড়া গ্রামের কয়লা ব্যবসায়ী এরশাদ মিয়া চালাতেন ঠেলাগাড়ি। ১০ বছরের ব্যবধানে তিনি প্রায় ১০ কোটি টাকার মালিক।
এমরান এন্টারপ্রাইজের মালিক তারা মিয়া মাঠে-ঘাটে শ্রমিকের কাজ করলেও কয়লা ব্যবসা করে বিরাট ধনী। নিজের নিরাপত্তার জন্য বন্দুক নিয়ে চলাফেলা করেন। এভাবে কয়লা আমদানির ফাঁকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে, সরকারকে ঠকিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন তাহিরপুরের মোশাররফ অ্যান্ড সন্সের মালিক মোশাররফ হোসেন, বাগলী চুনাপাথর ও কয়লা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুল খালেক ও সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, মোস্তাক অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক মোস্তাক আহমেদ, আতাউর এন্টারপ্রাইজের মালিক খসরুল আলম, খাজা ভাণ্ডারের মালিক স্বপন, রিপন ট্রেডার্সের মালিক মনমোহন পাল মতিশসহ তাহিরপুর উপজেলার প্রায় অর্ধশত কয়লা ও পাথর ব্যবসায়ী।
তাহিরপুর উপজেলার ষাটোর্ধ্ব ঈসমাইল হোসেনের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি আমলে এমন সময় গেছে যে ১০০ টন এলসি করে এক হাজার টন মাল দেশে নিয়ে এসেছে। এখন ১০০ টন এলসি করলে ২০০ টন নিয়ে আসে। আর এভাবেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কয়লা ব্যবসায়ীদের অনেকেই বাড়ি-গাড়িসহ প্রচুর সম্পদের মালিক বনে গেছেন।’
তাহিরপুর উপজেলার একাধিক আমদানিকারক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানান, তাঁরা ১০ বছর ধরে শতভাগ শুল্ক দিয়ে কয়লার ব্যবসা করেও খুব বেশি উন্নতি করতে পারেননি। আর কিছু লোকের দিন যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্পদ বাড়ছেই। শুল্ক স্টেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কয়লা আর পাথর আমদানি করে তাঁরা সম্পদের পাহাড় গড়ে চলেছেন।
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন খান বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আলখাছ উদ্দিন খন্দকার এখন টাকার জোরে আওয়ামী লীগ নেতা হয়েছেন। বড়ছড়া স্টেশন তাঁদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। একসময় দিনমজুরি করতেন, এখন তিনি কয়েক শ কোটি টাকার মালিক। যুবলীগের সাবেক একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে ম্যানেজ করে তাঁর ছেলেকে যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কও বানিয়েছেন তিনি। আর আমরা যারা প্রকৃত আওয়ামী লীগার, তারা খুবই কষ্টে আছি।’
তাহিরপুর উপজেলার কয়লা ও পাথর ব্যবসায়ীদের মতো কৌশলে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সিলেটের গোয়াইনঘাটের তামাবিল শুল্ক স্টেশনের কয়লা ও পাথর ব্যবসায়ীরাও। শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তামাবিল শুল্ক স্টেশনের আসিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. সরোয়ার হোসেন ছেদু, মো. জালাল উদ্দিন, লিয়াকত আলী, আব্দুল্লাহসহ অনেকের বিরুদ্ধে। আর ভোলাগঞ্জ স্টেশনের পাথর ও কয়লা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছেন সাহাবউদ্দিন মিয়া, দুদু মিয়া, নজরুল ইসলাম, কাউছার মিয়া, আমিরউদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, বশির আহমেদ, মজিবুর রহমান, ফজল মিয়া, নোমান আহমেদসহ ২৫ জনের বেশি; যাঁরা এলসিতে উল্লেখের চেয়ে অনেক বেশি কয়লা ও পাথর শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে আনছেন। তাঁদের বেশির ভাগই বহু কোটি টাকার মালিক।
কয়লার ব্যবসা করে খুব বেশি উন্নতি করতে পারেননি এমন কয়েকজন জানান, দুই দশক ধরে কয়লার ব্যবসা করে তেমন উন্নতি করতে পারেননি। কিন্তু অনেকেই তাঁদের সঙ্গে কয়লা আর পাথর আমদানি করে শহরে আর গ্রামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। এই অভিযোগ প্রসঙ্গে মোবারক এন্টারপ্রাইজের মালিক হাজি সামাদ মুন্সি বলেন, ‘দেখুন ভাই, আমি এক বছর ধরে কয়লার ব্যবসা করছি না। আর জীবনে কষ্ট করেছি বলেই এখন সুখে আছি।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আলখাছ উদ্দিন খন্দকার বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই আমরা তাহিরপুরে এসে চুনাপাথরখনিতে কাজ করি। বাবা কৃষিকাজ করতেন। ১৯৯৩ সালের দিকে কয়লা ব্যবসা শুরু করেই আজ এ পর্যন্ত এসেছি। কোনো ধরনের শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সঙ্গে আমি জড়িত নই। আর যেখানে পুলিশ, বিজিবি, কাস্টমস কর্মকর্তা আছেন, শুল্ক ফাঁকি দিলে তো তাঁরা দেখতেনই।’
রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন সিলেট বিভাগের ১৩টি এলসি স্টেশনের দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (কর) প্রভাত কুমার সিংহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলসি স্টেশনগুলো এখনো পোর্ট হিসেবে বাস্তবায়ন হয়নি। পোর্টের জন্য আমাদের জায়গা নির্ধারণের কাজ চলছে। জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এসব হয়ে গেলে প্রতিটি স্টেশনে ওজন মাপার আধুনিক যন্ত্র বসানো হবে। ইতিমধ্যে স্কেল বসানো হয়েছে, শতভাগ ওজন মাপা হয়। কিন্তু সেখানেও সমস্যা আছে, কম্পিউটারের মাধ্যমে স্কেলে ওজন মাপা হলেও লেখা হচ্ছে হাতে। ফলে কৌশলে ফাঁকি দিচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।’ তিনি জানান, স্কেলের বিষয়টি পোর্ট অথরিটি দেখবে; তারা এখনো পুরো ডিজিটাইজেশনে যেতে পারেনি, এখনো ম্যানুয়ালি করা হচ্ছে।
অফিস : ৪৪-ক, অতিশ দীপঙ্কর রোড, মুগদা, ঢাকা । সম্পাদকীয় কার্যালয় : আরএস ভবন, ১২০/এ মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইল : ০১৭৫৩-৫২৬৩৩৩ ই-মেইল : dainikkalerkhobor5@gmail.com
কারিগরি সহযোগিতায় ফ্লাস টেকনোলজি