মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৩ পূর্বাহ্ন
সোহেল হায়দার চৌধুরী, কালের খবর :
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া খোকা ধীরে ধীরে বাঙালির আরাধ্য পুরুষে পরিণত হন। দেশ ও মানুষের জন্য তার অব্যাহত লড়াই-সংগ্রামে নিবেদিত বঙ্গবন্ধু কাল থেকে কালান্তরে বিশ্বের শোষিত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের মুক্তির ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়ে যাবেন। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫-মাত্র ৫৫ বছর। এই সময়কালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশ বিভাগের আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশ গঠনের আন্দোলনে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। শোষিত মানুষের শোষণমুক্তির লক্ষ্যে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেছেন সারাজীবন।
বাঙালি ইতিহাসের সেই অনন্য মহানায়ককে নানা দৃষ্টিতে, নানা অভিধায় তুলে ধরা যায়। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন অনির্বাণ ব্যক্তিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে অনিঃশেষ হয়ে কালোত্তীর্ণ মহানায়ক হয়ে বেঁচে থাকবেন এমনটিই মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখছেন তাই তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে-
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ঐক্যের প্রতীক
বঙ্গবন্ধু গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, পৃথিবীতে আজ যে সংকট চলছে করোনাভাইরাসের কারণে সে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। এই সংকটে বৈশ্বিক ঐক্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ সংক্রামক ভাইরাস কোনো সীমারেখা মানে না। কোনো অঞ্চল বা ভৌগোলিক নির্দেশনা মানে না। আজ পৃথিবীকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। অথচ বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে পৃথিবীকে সক্রিয় রাখতে। এ সময় ঐক্যবদ্ধভাবে পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবী একটাই, প্রকৃতি একটাই। এটিকে আমরা মানচিত্রের মাধ্যমে বিভাজন করতে পারি সত্যি, কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হলে ছোট বা বড় সব দেশকেই এক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। আর সেটা হলো মানুষ।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নন, পুরো পৃথিবীর ঐক্যের প্রতীক। তিনি পৃথিবীকে সংকটমুক্ত করতে বৈশ্বিক ঐক্যের কথা বলে গেছেন সবসময়। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বলেছিলেন, বিশ্ববাসীর কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য পুরো পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন তাদের প্রতিনিধি হয়ে। তিনি জীবদ্দশায় যা বলে গেছেন, আজ বিশ্ব সম্প্রদায় সে পথে হাঁটছে। জাতিসংঘ বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) যে রূপরেখা তৈরি করেছে বঙ্গবন্ধু সে কথাটিই আন্তর্জাতিক মহলে বলেছিলেন। পৃথিবী আজ বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা পেলে সমস্যা-সংকট অনেক কমে যেত।
একজন নিখাদ বাঙালি মুসলমান
সাংবাদিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশ অভিন্ন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একজন আপসহীন জাতীয়তাবাদী নেতা এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালির অর্জনে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দুই দশকের বেশি লড়াই করেছেন। পাকিস্তানি শাসনামলে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, মিথ্যা অভিযোগে বারবার কারাবরণ করেছেন। কিন্তু সংগ্রাম থেকে একচুলও নড়েননি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার তিনটি সত্তা-তিনি খাঁটি বাঙালি, তিনি সাচ্চা মুসলমান এবং দুইয়ের সমন্বয়ে তিনি ছিলেন একজন নিখাদ বাঙালি মুসলমান। তিনি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত। তিনি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন এবং তা প্রতিষ্ঠা করে স্থান পেয়েছেন ইতিহাসের সিংহাসনে।
রাজনীতিবিদই শুধু নন, আদর্শের জন্মদাতা
খ্যাতিমান উন্নয়নকর্মী ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির মনে করেন বাঙালিদের কাছে বঙ্গবন্ধু চিরভাস্বর একজন মানুষ। শুধু ইতিহাসের জন্মদাতাই নন, একজন মহামানব হিসেবে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখলে চলবে না, তিনি যে একটি আদর্শের জন্ম দিয়ে গেছেন তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রাতঃস্মরণীয় এ নেতা বা মানুষটির আদর্শ চর্চা আজ খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বা ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে ক’জনই বা তাকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে পড়ছি বা পড়াচ্ছি একজন ঐিেতহাসিক ব্যক্তি হিসেবে, কিন্তু তিনি যে আদর্শের চর্চা করে গেছেন তা আমাদের মধ্যে নেই। আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চর্চাটা জরুরি। ‘
খুশী কবির বলেন, বঙ্গবন্ধু ধার্মিক হয়েও ধর্মনিরপেক্ষতার বড় উদাহরণ ছিলেন। উদার মনের মানুষ ছিলেন বলে ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন বা অধিকার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সোচ্চার একজন নেতা ছিলেন। তিনি নারী সমাজের মঙ্গলে গভীর পর্যালোচনা করে সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন। বাংলাদেশ বা পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনই বঙ্গবন্ধু থাকবেন, তবে তাকে সজীব রাখতে হলে তার আদর্শের চর্চাটা বাড়াতে হবে। রাজনীতি বা ব্যক্তিগত জীবনে এটার খুব দরকার আজ।
ভ্রাতৃত্ববোধ ও বন্ধন তৈরি করতে পেরেছিলেন
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর বলেন, বঙ্গবন্ধু একমাত্র নেতা যিনি তার পূর্বসূরিদের সঙ্গে রাজনীতি করেও ভেবেছেন উত্তরসূরিদের মতো। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন করেছেন শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটাতে। আওয়ামী লীগকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সময়োপযোগী একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার অসাধারণ কাজটি বঙ্গবন্ধু যেভাবে করেছেন তা পৃথিবীতে বিরল। তিনি একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ ধারণ করেও বামপন্থী বা অগ্রসর চিন্তার রাজনীতিবিদদের এক সুতোয় বাঁধতে পেরেছিলেন। তার সমগ্র কাজের মধ্যে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম লক্ষ্যণীয়।
রোকেয়া কবীর বলেন, শোষিত বঞ্চিতদের অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধু অগ্রসৈনিক। তিনি সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। কখনো চরমপন্থায় ভাবেননি কোনো কিছু। দৃঢ়চেতা, সংগ্রামী, কৌশলী ও মানুষের মন জয় করা একজন নেতা ছিলেন। দূরদর্শী নেতা ছিলেন বলে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে ও বন্ধন তৈরি করতে পেরেছিলেন। আজ যে বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তার ভিত বঙ্গবন্ধুই তৈরি করে দিয়ে গেছেন।