এ কে এম আতিকুর রহমান, কালের খবর :
কয়েক দিন আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোতে শেরিং চার দিনের এক সরকারি সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার, স্বাস্থ্য, কৃষি, পর্যটন এবং জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণক্ষেত্রে পাঁচটি দলিল স্বাক্ষরিত হয়।
২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই ডা. শেরিং চিকিৎসা পেশা ছেড়ে দিয়ে ভুটানের রাজনীতিতে যোগ দেন। ওই নির্বাচনে তাঁর দল ড্রুক ন্যামরুপ শগপা (ডিএনটি) প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে এবং প্রাথমিক রাউন্ডে ১৭.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান দখল করে। নিয়মানুযায়ী বেশি ভোট পাওয়া দুটি দল মাত্র দ্বিতীয়—অর্থাৎ ফাইনাল রাউন্ডে যায়। তাই তাঁর দলের পক্ষে ফাইনালে লড়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আশাহত হলেও হাল ছাড়েননি তিনি। দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুললেন পাঁচ বছর ধরে। অবশেষে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল বিজয়ী হয়। ওই বছরের ৭ নভেম্বর সরকার গঠন করলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
ভুটানে ২০০৮ সালে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর এটি ছিল তৃতীয় জাতীয় নির্বাচন। আর তিনটি নির্বাচনেই তিনটি ভিন্ন দল একবার করে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক কারণেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর লোতে শেরিং সর্বপ্রথম তাঁর বিদেশ সফরে ভারতে যান। আর বাংলাদেশে এটি ছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সফর। যা-ই হোক, আজ আমি এখানে ডা. শেরিংয়ের রাজনৈতিক জীবন বা বাংলাদেশ-ভুটান সম্পর্ক নিয়ে লিখছি না। আজকের প্রসঙ্গ অন্য কিছু।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যেই জানা গেল যে লোতে শেরিং আমাদের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। এ খবর অবশ্যই আমাদের পুলকিত করেছিল। আমাদের ধারণা, এ সফরকালে তাঁর সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি দেখতে যাওয়ার বিষয়টি সফরের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভুটানের পক্ষ থেকে অনুরোধ ছিল। আর কাকতালীয়ভাবে ওই দিনটি পড়ে গিয়েছিল ঠিক বাংলা নববর্ষের দিন। তাঁর সম্মানে দেওয়া কলেজ কর্তৃপক্ষের আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর একসময়ের সহপাঠীরাও। কলেজের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সুধীজনদের সেই সমাবেশে তিনি বাংলায় বলেছিলেন, ‘ভালো চিকিৎসক হতে হলে আগে একটা ভালো মানুষ হতে হবে, ভাই। মাঠ ভালো না হলে যা-ই রোপি না কেন, কিছু উঠবে না সেখানে। ’
সম্ভবত একজন চিকিৎসক হিসেবেই তিনি এ উদাহরণ দিয়েছিলেন। আসলে চিকিৎসক হতে হলেই যে একজন ভালো মানুষ হতে হবে, তা নয়। এটি সর্বক্ষেত্রে সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য। ভালো পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র গড়তে হলে আমাদের প্রত্যেকেরই ভালো মানুষ হওয়া দরকার। সমাজের বা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভালো মানুষের খুবই প্রয়োজন—হোক সে কৃষক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সমাজসেবক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি বা যেকোনো পেশার মানুষ। ভালো মানুষ না হলে একজন ব্যক্তি কী করে অন্য মানুষের সেবা করবে, সঠিক পথের সন্ধান দেবে? যতই সম্পদ থাকুক না কেন, ভালো মানুষ ছাড়া কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র উন্নতি লাভ করতে পারে না। তবে এ জন্য প্রয়োজন যেমন প্রবল অঙ্গীকার, তেমনি অনুকূল পরিবেশ।
একটি সমাজকে আদর্শ সমাজে পরিবর্তন করতে আমাদের ভালো মানুষরাই তার স্তম্ভ হতে পারেন। তাঁরা স্বভাবতই সৎ, নিঃস্বার্থ, অঙ্গীকারবদ্ধ, দেশপ্রেমিক ও দয়ালু হয়ে থাকেন। কোনো সাহায্য করতে পারেন বা না পারেন, তাঁরা অন্যের দুঃখ-বেদনা অনুভব করেন। তাঁদের সুযোগ দেওয়া হলে তাঁরা অনেক ভালো কাজই করতে পারেন। সত্যি বলতে কি, আমরা দেশের কল্যাণে তাঁদের সাহায্য নেওয়ার চিন্তা কদাচিৎ করে থাকি। বরং ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণে সক্ষম অন্যদেরই প্রাধান্য দিই। আমাদের এই দুর্ভাগ্যের সঙ্গেই বাস করতে হচ্ছে এবং আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে কোনো একদিন সমাজ থেকে এসব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ভালো মানুষ হওয়া অত সহজ নয়। ভালো মানুষ হওয়া সত্যি কঠিন এবং তার চেয়ে বেশি কঠিন ভালো মানুষ হিসেবে আমাদের সমাজে টিকে থাকা।
জানি না, আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ একমত হবেন কি না যে আমাদের দেশে ভালো মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ভালো মানুষের বড়ই অভাব এ দেশে। যে দু-চারজন খুঁজে পাওয়া যাবে, তাঁরাও কিছু করতে পারবেন—এমন পরিবেশ আছে বলে হলফ করে বলা যায় না। ভালো মানুষের মূল্যায়ন কি করা হয়? তাঁরা কি অবহেলিত হচ্ছেন না? ভালো মানুষগুলো কি সঠিক পথে, সত্য ও ন্যায়নীতির পথে চলতে সক্ষম হচ্ছেন? হাজারো প্রতিবন্ধকতা এসে তাঁদের চলার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। হা-হুতাশ করা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার থাকে না। জীবনের কুিসত বাস্তবতা তাঁদের আহত করে। তাঁদের নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। পরিবার-পরিজন তাঁদের নিয়ে উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়ে, দুশ্চিন্তার কোনো অন্ত থাকে না। এহেন পরিবেশে কে চাইবে ভালো মানুষ হতে?
আমাদের আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো আর সময় নেই। এখনই সেই সংগ্রামে নেমে পড়তে হবে। পরিবেশ পাল্টাতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ভালো মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে। শুধু মুখে বললেই হবে না, বাস্তবভাবে দেখাতে হবে যে আমরা সেটি করতে চাই। সমাজে যে কজনই ভালো মানুষ রয়েছেন, তাঁদের একত্র করতে হবে। সেই চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। আমাদের শক্তির উৎস হবেন ভালো মানুষগুলোই। আমাদের সাহস এই যে ভালো মানুষরা কখনো ভয় পান না। আমি আশাবাদী যে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর ওই কথাগুলো আমাদের জনগণকে তথা যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করবে এবং সবাই ভালো মানুষ তৈরির পরিবেশ সৃজনে দেশকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবে। আমাদের পাশের এ ছোট্ট প্রতিবেশী ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোতে শেরিং চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁর দেশে কোনো মেডিক্যাল কলেজ নেই বিধায় মেডিক্যালে পড়তে সে দেশের ছাত্রদের প্রতিবছরই বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে যেতে হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন উপলক্ষে তিনি প্রায় ১০ বছর এ দেশে কাটিয়েছেন। তিনি সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে আমাদের এ অঞ্চলে ভালো মানুষের অভাব রয়েছে। তাই মনের অগোচরে কথাটি তিনি অকাতরে বলেই ফেলেছেন। আমার সঙ্গে অনেকেই বোধ হয় একমত হবেন যে তিনি কত কঠিন অথচ সত্য কথাটি নিঃসংকোচে উচ্চারণ করেছেন তাঁর ওই স্মৃতিচারণায়।
আমি একবার মালয়েশিয়ার সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের কাজে একজন চিকিৎসক হওয়ায় তিনি কি কোনো বিশেষ সুবিধা খুঁজে পেয়েছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, চিকিৎসক হওয়ায় তিনি রাষ্ট্রীয় যেকোনো সমস্যার ডায়াগনসিস করে তা সমাধানের প্রেসক্রিপশন দেওয়ার অভ্যাসটা রপ্ত করেছিলেন; যার ফলে তিনি মালয়েশিয়াকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী যদি ডা. মাহাথিরের মতোই তাঁর চিকিৎসা-অভ্যাস রাজনৈতিক আঙ্গিকে দেশের কল্যাণে প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন এবং একজন ভালো মানুষের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হন, তাহলে ভুটান একটি আধুনিক দেশে পরিণত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বোপরি যতটুকু জানি, ভুটানের রাজা ও জনগণ এ ব্যাপারে তাঁকে সার্বিক সাহায্য, সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব।
অফিস : ৪৪-ক, অতিশ দীপঙ্কর রোড, মুগদা, ঢাকা । সম্পাদকীয় কার্যালয় : আরএস ভবন, ১২০/এ মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইল : ০১৭৫৩-৫২৬৩৩৩ ই-মেইল : dainikkalerkhobor5@gmail.com
কারিগরি সহযোগিতায় ফ্লাস টেকনোলজি