সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১০ পূর্বাহ্ন
কালের খবর প্রতিবেদক ঃ
স্বাস্থ্য সেক্টরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আফজাল হোসেনের দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসার পর আতঙ্ক আরো বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে গুরুত্বপূর্ণ শাখায় কর্মরত কর্মচারীরা দেখে শুনে চলাফেরা করছেন। নিজেদের সম্পদ গোপন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আফজাল হোসেনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কোটিপতি কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কে দুর্নীতির তথ্য পেয়েছেন তারা। এ তালিকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইপিআই বিভাগের কর্মচারী তোফায়েল আহমেদ ও কমিউনিটি ক্লিনিক বিভাগের কর্মচারী আনোয়ার হোসেনের নাম রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কর্মচারী সমিতির নেতাদের নামও দুর্নীতিবাজদের তালিকায় রয়েছে। এদিকে দুদকের বরাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী আফজাল হোসেনের দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ্যে আসার পর রীতিমত হৈ চৈ পড়ে যায় সর্বত্র।
একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা হয়ে এত সম্পদের মালিক হন কিভাবে! এসব প্রশ্ন যখন সবার মুখে মুখে তখন অধিদপ্তর আফজালকে সাময়িক বরখাস্তের নোটিশ দেয়। গত রোববার এক চিঠিতে তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ পদে কাজ করে ঢাকায় ও দেশের বাইরে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লটের মালিক হয়েছেন আফজাল। রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল গাড়িও।
এসব সম্পদ থাকার অভিযোগে দুদক এরই মধ্যে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদও করে আফজালকে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা মডেল টাউনের ১৩নং সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৪৭ নম্বর বাড়িটি তার। তবে তামান্না ভিলা নামের ওই বিলাসবহুল বাড়ির মালিক আফজাল হলেও দলিল করা হয়েছে তার স্ত্রী রুবিনা খানমের নামে। রুবিনাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পদে কর্মরত। জানা গেছে, জমিসহ ওই বাড়ির মূল্য ১৫ কোটি টাকা। এই বাড়ি ছাড়াও উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে আরো দুটি ভবন রয়েছে আফজালের। যার নম্বর যথাক্রমে ৬২ ও ৬৬। একই সড়কে ৪৯ নম্বর প্লটটিও ওই হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কেনা। দুদক জানায়, এসবের বাইরে সিটি ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা করেছেন আফজাল। এ ছাড়া, আরব বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি হিসাবের তথ্যও পেয়েছে দুদক। দুদক জানায়, ঢাকা ছাড়াও আফজাল তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি কিনেছেন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরেও বিপুল অঙ্কের অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মচারীর বরাতে জানা যায়, কয়েকদিন পর পরই পুরনো গাড়ি বদলে নিত্যনতুন গাড়ি ব্যবহার করেন। প্রাডো, পাজেরো, হ্যারিয়ারের মতো দামি গাড়ির মালিক তিনি। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, বিএনপি সরকারের আমল থেকে রাজনীতিকে ব্যবহার করে কাজ চালিয়ে যেতেন। সে সময় অধিপ্তরের একটি কমিটিও ছিল। সেই কমিটির নেতা ছিলেন আফজাল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রূপ বদলাতে সময় লাগেনি তার। রাতারাতি তিনি বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগের ঘরানার নেতা হয়ে ওঠেন। আফজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানম এক সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি করতেন। পরে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তাকে প্রকল্প থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়মিত করা হয়। একটি সূত্র বলছে, সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি সিন্ডিকেটের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত আফজাল। চলতি শিক্ষা বছরেও মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বাণিজ্য হয়েছে, যার পুরোভাগে ছিলেন আফজাল হোসেন। দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ গড়ার বিষয়ে তাকে একাধিকবার ফোন করলেও তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তার এত দুর্নীতির খবর ফাঁসে অনেকটা ভীতি কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তাদের মাঝেও। জানা গেছে, একই প্রতিষ্ঠানের আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত। যাদের সম্পদের হিসাব খোঁজা এরই মধ্যে দুদক শুরু করেছে। আর এসব কারণে ওই সব কর্মকর্তাদের মধ্যে দুদক আতঙ্ক ভর করেছে। যেকোনো দিন কমিশন তাদের তলব করতে পারে। এদিকে দুর্নীতির অভিযোগে এরই মধ্যে কমিশন আফজাল ছাড়াও আরো তিন কর্মকর্তাকে তলব করেছে। তার মধ্যে সোমবার দুদকের কার্যালয়ে বাজেট বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজিরা দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। তবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন ডা. আনিসুর রহমান। উল্লেখ্য, গত ৯ই জানুয়ারি দুদকের উপ-পরিচালক সামসুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর ৪ জনকে তলব করে নোটিশ পাঠানো হয়। যাদেরকে তলব করা হয়। তারা হলেন- পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, অধ্যাপক ডা. আবদুর রশীদ, সহকারী পরিচালক (বাজেট) ডা. আনিসুর রহমান ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আফজাল হোসেন। এদের মধ্যে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হন ডা. আনিসুর রহমান ও আফজাল হোসেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে টেলিফোনে দুদিন সময় চেয়েছেন পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন। আর ১৫ দিনের সময় চেয়ে আবেদন করেছেন লাইন ডিরেক্টর ডা. আবদুর রশিদ। দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা। এ ছাড়া বিদেশে অর্থ পাচার ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।